জীবিত হতে আবেদন!

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৮:৩৯, আগস্ট ৩১ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ আবদুল ছাত্তার মিয়া, জন্ম ১৯৩৮ সালে। বয়স প্রায় ৮৩ বছর। বৃদ্ধ বয়সে সরকারি সহায়তা হিসেবে পেতেন বয়স্ক ভাতা। তবে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেছে তার ভাতা। কারণ বেচেঁ থাকলেও কাগজে–কলমে তিনি এখন মৃত। তথ্য সংগ্রকারীরা ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ভুল তথ্য দেওয়ায় বেঁচে থেকেও এখন তিনি মৃত। ভুক্তভোগী আবদুল ছাত্তার মিয়ার বাড়ি মির্জাগঞ্জ উপজেলার মজিদবাড়িয়া ইউনিয়নের মজিদবাড়িয়া গ্রামে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আবদুল ছাত্তার মিয়া বলেন, ‘কীভাবে আমি মারা গেলাম বুঝতে পারছি না।’ একই রকম সমস্যায় পড়েছেন মির্জাগঞ্জ উপজেলার কাকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের মো. করিম হাওলাদার। ২০০৮ সালে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্র পান। ভোটও দিয়েছেন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে। কিন্তু ২০২১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। তখন মনে করেছিলেন, ভুলে হয়তো কেন্দ্রের ভোটার তালিকায় তার নাম আসেনি। তবে কয়েক মাস ধরে বয়স্ক ভাতা না পাওয়ায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান তিনি। সেখানে গিয়েই নিজের ‘মৃত্যুর’ খবর পান! দশমিনা উপজেলার বাসিন্দা ভোটার তালিকায় মৃত হওয়া মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ভোটার তথ্য হালনাগাদের সময় ভুল তথ্য দিয়ে আমাকে মৃত দেখানো হয়েছে। ভোটার তালিকায় আমি মৃত হওয়ায় করোনার টিকা পর্যন্ত নিতে পারিনি । ইউপি সদস্য নির্বচন করতে গিয়েও বাধাগ্রস্ত হয়েছি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারছি না। বঞ্চিত হচ্ছি রাষ্ট্রীয় সেবা থেকেও। মোছা. সালমা আক্তার (৩৫) 'দশমিনা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের' প্রধান শিক্ষিকা। কিন্তু ভোটার তালিকায় তিনি মৃত। সালমা আক্তার ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারির প্রাথমিকের ইএফটির তথ্য দিতে গিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে যান সালমা আক্তার। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন তিনি মৃত! তাই তার ভোটার আইডি কার্ডটি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এতে বিপাকে পরেন এই শিক্ষিকা। বর্তমানে তার বেতন ভাতা বন্ধ রয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। এখন ভোটার আইডিতে মৃত দেখানোর কারণে করোনার টিকাও নিতে পারেননি তিনি। সালমা আক্তার ও তার পরিবারের সদস্যরা জানান, সালমা আক্তার ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দশমিনা উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের ৩৫ নম্বর চরহোসনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি করতেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে উপজেলা সদরের ১৩৬ নম্বর কাটাখালী গাজী বাড়ি সংলগ্ন আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। চরহোসনাবাদে চাকরি করার সময় ২০১৫ সালের দিকে তার ভোটার তথ্য হালানাগাদে ভুল তথ্য দিয়ে মৃত দেখান একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন। তথ্য হালানাগাদে দেখানো হয় ২০১৫ সালের ৩০ জুন তিনি মারা গেছেন। আর এসব ভুল তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই স্বাক্ষর করে দেন ভোটার তথ্য হালানাগাদে থাকা শনাক্তকারী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আবুল কালাম এবং ভোটার তথ্য হালানাগাদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সুপারভাইজার মো. হোসেন আহাম্মদ। তবে তথ্য সংগ্রহের সময় বিষয়টি অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভোটার আইডি কার্ডের তথ্য সংগ্রহকারী শিক্ষক মো. আলাউদ্দিন। এদিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আবুল কালাম বলেন, আমি বিশ্বাসের ওপর না বুঝে ভুল তথ্যে স্বাক্ষর দিয়েছি। আবদুল ছাত্তার, করিম হাওলাদারের মতো মির্জাগঞ্জ উপজেলার মির্জাগঞ্জ ইউনিয়নের আমেনা বেগম, সমর্তবান বেগম, সোহরাব গোলদার, মাধবখালী ইউনিয়ন হাজেরা বেগম, কাকড়াবুনিয়া ইউনিয়নের মো. খলিল হাওলাদার, মজিদবাড়িয়া আম্বিয়া বেগম ও আবদুল ছত্তারকেও ভোটার তালিকায় ‘মৃত’ দেখানো হয়েছে। এ অবস্থায় তাদের বয়স্ক ভাতা বন্ধ রয়েছে। বয়স্ক ভাতা পেতে তারা সম্প্রতি ‘জীবিত’ হওয়ার আবেদন করেছেন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে। এ অবস্থায় দশমিনা উপজেলার মোছা. সালমা আক্তার, মো. নজরুল ইসলাম ও হাবিব পালোয়ানসহ জীবিত হয়েও ভোটের তালিকায় মৃত হয়ে আছে ১২ জন, বাউফল উপজেলায় দু'জন, গলাচিপা উপজেলায় একজন এবং দুমকিত উপজেলায় একজন ভুক্তভোগী আবেদন করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন জেলা -উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তারা। এ বিষয় দশমিনা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান বলেন, আবেদন ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পটুয়াখালী সমাজ সেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক শীলা রানী দাস বলেন, বিগত বছরগুলোতে ম্যানুয়ালি বয়স্কভাতা দেওয়া হতো। তবে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) মাধ্যমে বয়স্কভাতা দেওয়ার কার্যক্রম শুরুর পর আমরা ভাতাভোগীদের তথ্য ডাটাবেজে ইনপুট দিচ্ছি। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনের ডাটাবেজ বলছে অনেক ব্যক্তি মারা গেছেন। এ নিয়ে জেলায় ১২ জনের এ সমস্যা পেয়েছি। সে কারণে তাদের তথ্য দেওয়া যাচ্ছে না। তাই আপাতত ভাতা বন্ধ রয়েছে। তবে এরা যাতে দ্রুত নির্বাচন অফিস থেকে তাদের তথ্য হালনাগাদ করতে পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসে আমরা বলে দিয়েছি। পটুয়াখালী জেলা সিনিয়র নির্বাচন অফিসার খান আবি শাহানুর খান বলেন, হালনাগাদ ভোটার তালিকায় কতজনের তথ্যে এমন বিভ্রান্তি রয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে কোনও উপজেলায় এমনটি ঘটলে সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তথ্য উপাত্ত নিয়ে আবেদন করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।