১০০ বছরে একবার আসে মহামারী

কামরুন নাহার | ০০:৫৮, ফেব্রুয়ারি ২০ ২০২০ মিনিট

রিপোর্ট দেশ জনপদ ॥ মানব ইতিহাসে প্রতি ১০০ বছরে ফিরে আসে মহামারী। পাল্টে দেয় পৃথিবীর চেহারা। কখনো নতুন করে শুরু হয় সভ্যতা। প্লেগ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, যক্ষ্মা, কলেরা, গুটিবসন্ত কখনো মহামারী হয়ে এসে কেড়ে নেয় কোটি কোটি মানুষের প্রাণ। মহামারীর কারণে বহু নগরসভ্যতা হারিয়ে গেছে। কয়েক হাজার বছর আগের অবিকৃত মিসরীয় মমির গায়েও পাওয়া যায় গুটিবসন্তের চিহ্ন। গোটা পৃথিবী শাসন করা ফারাওরা নিজেদের দেবতা দাবি করত। গুটিবসন্তের কাছে তারাও হার মেনেছিল। ২৫০ খ্রিস্টাব্দে সাইপ্রিয়ানের প্লেগ রোমান সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল। রোমান রাজপরিবারেও হানা দেয় প্রাণঘাতী এই জীবাণু। মহামারীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর চিত্র দেখা যায় ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সালে। এ মহামারী ব্ল্যাক ডেথ নামে কুখ্যাতি পেয়েছিল। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র সাত বছরে মারা গিয়েছিল অন্তত আট কোটি মানুষ। তিন থেকে সাত দিনের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত আক্রান্তরা। মধ্য এশিয়ার সমভূমিতে এই রোগের জন্ম। এরপর এটি সিল্ক রোড হয়ে ক্রিমিয়ায় পৌঁছায়। বণিকদের জাহাজে বসবাস করা কালো ইঁদুর ও ইঁদুর মাছি নামে দুটি প্রজাতির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে প্লেগ। এই মহামারীর কবলে পড়ে ১৪শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। মানুষের প্রাচীনতম ফসিল, সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিভিন্ন রোগ কীভাবে পাল্টে দিয়েছে পৃথিবীর গল্প। মহামারী কয়েক মাসে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে জনপদ। রোমে গুটিবসন্ত মহামারী রূপ নিয়েছিল ১৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এ যেন অভিশাপ- ভেবে পালিয়ে যাচ্ছিল নগরবাসী। কিন্তু মৃত্যু পিছু ছাড়েনি। ১৫ বছরের ব্যবধানে রোম রীতিমতো ভুতুড়ে শহর হয়ে ওঠে। ৪৩০ খ্রিস্টাব্দে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে গ্রিসে। এথেন্স তখন গ্রিসের ফুসফুস। প্লেগ এসে তছনছ করে দেয় এথেন্সকে। এক লাখ মানুষ মারা যায় সে সময়। একশ বছর পর ইউরোপ, মিসর ও পশ্চিম এশিয়ায় প্লেগের ছোবল লাগে। গোটা পৃথিবীর ৪০ শতাংশ মানুষ সে সময় মারা গিয়েছিল। মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতো না। পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল এ রোগটি। ‘প্লেগ অব শ্যারো’ ছড়িয়ে পড়েছিল বর্তমান ইরানে। মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে মাত্র এক বছরে এক লাখ মানুষের মৃত্যুর কথা ধারণা করা হয়। কেউ রোগাক্রান্ত হলে ছুটে পালাত তার সঙ্গী-স্বজনরা। পার্সিয়ার অর্ধেক মানুষই মারা যায় তখন। ৭৩৫ থেকে ৭৩৭ সাল। দুই বছরে গুটিবসন্ত বা স্মল পক্সে জাপান জনমানবশূন্য হয়ে যায়। জাপানের তিনভাগের একভাগ মানুষ সেই মহামারীতে মারা যায়। এই শতাব্দীতে বাইজ্যান্টাইন সাম্রাজ্য প্লেগের কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। প্রতি ১০০ বছর ঘুরে মহামারীর এমন ভয়াবহ চিত্র দেখেছে মানব জাতি। ষোলো শতাব্দীতে নিউ স্পেনে (বর্তমান মেক্সিকো) স্যালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়া নিশ্চিহ্ন করে দেয় জনপদ। মেক্সিকোকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া এ রোগের কারণে অ্যাজটেক সভ্যতা পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে পড়ে। এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ মানুষ মারা যায়। ১৫৬৩ সালে লন্ডন প্লেগে মারা গিয়েছিল বিশ হাজারেরও বেশি মানুষ। তবে মৃতের এই সংখ্যা নগণ্য মনে হয় পরের শতকে। ১৬১৬ সালে লন্ডন দেখে মহামারীর আসল রূপ। স্মল পক্স, ইনফ্লুয়েঞ্জা, টাইফাস, অজানা আরও ভাইরাস জ্বরে লন্ডন মৃত্যুর মুখে পড়ে। ঘরে ঘরে অজানা রোগে মানুষ মরতে শুরু করে। মৃত্যুর এমন মিছিল লন্ডন কবে দেখেছিল কে জানে? লন্ডনের ৯০ শতাংশ মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হয়। লন্ডন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ১৬২৯-১৬৩১ সালে ইতালিতে ছড়িয়ে পড়া প্লেগ রোগে আড়াই লাখ মানুষ মারা যায়। গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন, গ্রেট প্লেগ অব অস্ট্রিয়া কয়েক লাখ প্রাণহানি ঘটিয়েছিল। এরপরের শতকে বলকান অঞ্চলে মহামারী আঘাত করে। ৫০ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল ১৭৩৮ সালের প্লেগে। একই শতকে রাশিয়া ও পার্সিয়া ভয়ঙ্কর মহামারীর মুখে পড়ে। দুই লাখ মানুষ মারা যাওয়ার পর পার্সিয়া অভিশপ্ত হিসেবে গণ্য হতো। উনিশ শতকে এলো কলেরা। ইউরোপ ও এশিয়ায় এক লাখ মানুষ কলেরায় মারা যায় ১০ বছরের ব্যবধানে। সে সময় কলেরা প্রতিরোধের কোনো উপায় খুঁজে পায়নি বিশ্ব। উনিশ শতকের মাঝামাঝি নিশ্চিত মৃত্যুর অপর নাম হয়ে ওঠে রোগটি। কলেরা তখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকাতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখে। তৃতীয়বারের মতো কলেরা মহামারীর রূপ নেয় রাশিয়াতে। সেখানেও এক লাখের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কথা বলা হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর আগে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। জ্বরের আদলে এই রোগে প্রাণ যায় এক লাখের বেশি মানুষ। এরপর চীনে প্লেগ কেড়ে নেয় অর্ধলাখ মানুষের জীবন। বিংশ শতাব্দীর আলোচিত মহামারী এশিয়ান ফ্লু। প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায় এ রোগে। রোগটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে। এত বিস্তৃত মহামারী পৃথিবীর ইতিহাসে কমই আছে। ১৯৬০ সালে পৃথিবীবাসী মুখোমুখি হয় এইচআইভি বা এইডসের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত ৩০ লাখ মানুষ মারা গেছে এ রোগে। পোলিওতে ভুগেও বিশ্বের নানা প্রান্তে অকালে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মহামারী হিসেবে দেখা হচ্ছে করোনাভাইরাসকে। এ শতাব্দীতে সার্স, মার্স, ডেঙ্গু, জিকা, ইবোলার মতো প্রাণঘাতী রোগের কথা জেনেছে বিশ্ব। কিন্তু সব কিছুকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে চীনের করোনাভাইরাস। গতকাল পর্যন্ত ৭১ হাজারেরও বেশি মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যুবরণ করেছে ১ হাজার ৭৭২ জন। মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। মহামারী হয়ে ওঠা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী এ পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে ২৮টি দেশে।