রিপোর্ট দেশ জনপদ ॥ কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারিঘাট, আজ বেলা ১১টা। নদীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে কয়েক শ মাছ ধরার ট্রলার। ট্রলারের জেলেরা মহাব্যস্ত। কেউ মাছ ধরার জাল গুছিয়ে নিচ্ছেন, কেউ আহরিত মাছ সংরক্ষণের জন্য ট্রলারে বরফ বোঝাই করছেন। কেউ মাছ রাখার কক্ষ পরিষ্কার এবং কয়েক দিনের জ্বালানি ও রসদ ট্রলারে বোঝাই করে সমুদ্রযাত্রা শুরু করছেন। উদ্দেশ্য রুপালি ইলিশ ধরা।
খুশিতে আত্মহারা এফবি আল্লাহর দান ট্রলারের জেলে কলিম উল্লাহ (৪৭) বলেন, গত ২৩ জুলাই শেষ হয়েছিল ৬৫ দিনের মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞা। অতিমারির এই দুঃসময়ে নিষেধাজ্ঞার ওই ৬৫ দিন কেটেছে খেয়ে না খেয়ে। আশা ছিল, নিষেধাজ্ঞা শেষে মাছ ধরে সেই অভাব দূর করবেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার আগেই শুরু হলো সাগরে লঘুচাপ, ভারী বর্ষণ। এ কারণে উত্তাল সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া হয়নি টানা আরও ১০-১২ দিন। এখন সাগর শান্ত, উপকূলের ৪০-৮০ কিলোমিটার দূরে (গভীর সাগরে) গিয়ে জাল ফেললেই ধরা পড়বে বড় বড় রুপালি ইলিশ। এই ইলিশ বিক্রি করেই দূর করবেন সংসারের অভাব।
বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা, ছয় নম্বর ঘাট, কস্তুরাঘাট, মাঝেরঘাট এলাকায়ও সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে আরও অন্তত এক হাজার ট্রলার। সন্ধ্যার আগেই এসব ট্রলার নেমে পড়বে সাগরে ইলিশসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ধরতে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ থেকে আজ বুধবার সকালে ইলিশ ধরতে সাগরে নেমেছে ২৮০টি ট্রলার। ট্রলারগুলো দ্বীপের পশ্চিমে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে জাল ফেলবে জানিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, জেলেদের আশা, এবার তাঁদের জালে বড় বড় ইলিশ ধরা পড়বে। দু-এক দিনের মধ্যে দ্বীপের আরও কিছু ট্রলার সাগরে নামবে ইলিশ ধরতে।
কয়েক দিনের মাথায় সাগর থেকে জেলেরা বিপুল ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরবেন, তখন হাটবাজার ইলিশে সয়লাব হবে। বিপুল পরিমাণ ইলিশ সরবরাহ হবে চট্টগ্রাম, ঢাকা, বগুড়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
আজ দুপুর ১২টার আগে শাহপরীর দ্বীপ, টেকনাফ থেকেও সাগরে নেমেছে আরও পাঁচ শতাধিক ট্রলার। কিছু ট্রলার আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরের মধ্যে ঘাটে ফিরবে বলে জানিয়েছে কয়েক ট্রলারমালিক।
জেলার টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চকরিয়া উপজেলার অন্তত ছয় হাজার ট্রলার সাগরে নামছে ইলিশ ধরতে। কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, টানা প্রায় ৮০ দিন জেলেরা সাগরে নামতে পারেননি সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও দুর্যোগের কারণে। দীর্ঘ সময় মাছ আহরণ বন্ধ থাকায় সাগরে মাছের প্রজনন ও আকৃতি বেড়েছে অনেক। কয়েক দিনের মাথায় সাগর থেকে জেলেরা বিপুল ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরবেন, তখন হাটবাজার ইলিশে সয়লাব হবে। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে কক্সবাজারের বিপুল পরিমাণ ইলিশ সরবরাহ হবে চট্টগ্রাম, ঢাকা, বগুড়া, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
শহরের ফিশারিঘাটের পাশে বাঁকখালী নদী। বাঁকখালী নদী থেকে ট্রলার ছেড়ে প্রথমে মহেশখালী চ্যানেল, তারপর সোনাদিয়া দ্বীপ হয়ে ট্রলার ছুটছে গভীর সাগরের দিকে। আজ দুপুর পর্যন্ত বাঁকখালী নদী ও মহেশখালী চ্যানেলে নেমে কয়েক শ ট্রলারের সমুদ্রযাত্রা নজরে পড়েছে। ফিশারিঘাটে কথা হয় স্থানীয় নুনিয়াছটার জেলে সলিম উল্লাহর সঙ্গে। সলিম উল্লাহ (৫৫) বলেন, ২৯ বছর ধরে তিনি সাগরে ইলিশ ধরছেন। এবার তাঁরা ট্রলার নিয়ে ইলিশ ধরতে যাবেন সেন্ট মার্টিন উপকূলের দিকে। সেখানে গিয়ে ইলিশের দেখা না মিললে পশ্চিম দিকে সাগরের ৪০-৫০ কিলোমিটার ভেতরে গিয়ে জাল ফেলবেন। এই দুই জায়গায় অবশ্যই ইলিশের বিচরণ থাকবে জানিয়ে এই অভিজ্ঞ জেলে বলেন, সাগরে পানি দেখলেই তিনি বুঝতে পারেন, ইলিশের বিচরণ আছে কি না। ইলিশ দল বেঁধে চলে। ইলিশের বিচরণ যেখানে, সেখানকার পানি লালচে রং ধারণ করে।
কক্সবাজার শহরে বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার একটি বরফ কল থেকে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ নিচ্ছে একাধিক ট্রলার। বুধবার দুপুরে
কক্সবাজার শহরে বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটার একটি বরফ কল থেকে মাছ সংরক্ষণের জন্য বরফ নিচ্ছে একাধিক ট্রলার। বুধবার দুপুরে
তবে কয়েক জেলে জলদস্যু হামলার শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাগরে ইলিশ ধরা পড়লে জলদস্যুদের তৎপরতা বেড়ে যায়। জেলেরা যখন ইলিশ আহরণ করে ঘাটে ফিরতে শুরু করেন, তখন অস্ত্রধারী জলদস্যুরা সাগরের মহেশখালী, সোনাদিয়া চ্যানেলে জেলেদের জিম্মি করে আহরিত মাছ, জাল লুট করে। এ সময় হতাহতের ঘটনাও ঘটে।
জেলার বৃহৎ পাইকারি মাছের বাজার নুনিয়াছটার এই ফিশারিঘাট মৎস্য অবতরণকেন্দ্র। সাগর থেকে আহরিত অধিকাংশ মাছ এ ঘাটে বেচাবিক্রি হয়। টানা আড়াই মাস ধরে অবতরণকেন্দ্রটি মৎস্যশূন্য ফাঁকা পড়ে আছে। দুপুরে এই কেন্দ্রে কথা হয় মৎস্য ব্যবসায়ী মো. জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে। তিনি কক্সবাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সমিতির সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
জয়নাল আবেদীন বলেন, সন্ধ্যার মধ্যে জেলার ছয় হাজার ছোট–বড় ট্রলার সাগরে নেমে পড়বে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরতে। পাঁচ-ছয় দিন পর এই মাছ বিক্রির জন্য আনা হবে এই কেন্দ্রে। তাই আগেভাগে মাছ সংরক্ষণের প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হচ্ছে। ইলিশ, রুপচাঁদা, কোরাল, লাক্ষা, চাপা, গুইজ্যাসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এখান থেকে ট্রাকে বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হবে।
জয়নাল আবেদীন আরও বলেন, আগে এই পাইকারি বাজারে ৮০০ গ্রামের বেশি ওজনের ১০০টি ইলিশ ২৮ হাজার টাকায়, ৭০০ গ্রামের বেশি ১০০টি ইলিশ ২৫ হাজার টাকায় এবং ৬০০ গ্রামের কম ওজনের ১০০টি ইলিশ ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতেন জেলেরা। এখন ইলিশের দাম শুরুর দিকে প্রতি শয়ে দুই-তিন হাজার টাকা বাড়তে পারে। পরে ইলিশের সয়লাব হলে দাম কমেও যেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইলিশের দাম নির্ধারণ হয় ঢাকার বাজার পরিস্থিতির ওপর।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, গত বছর জেলায় ইলিশ আহরণ হয়েছিল ১৫ হাজার ২৫৬ মেট্রিক টন। এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার মেট্রিক টন। গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন সাগরে মাছ আহরণ বন্ধ ছিল। এ কারণে ইলিশের প্রজনন ও আকৃতি বেড়েছে অনেক গুণ। দুর্যোগকাল কাটিয়ে জেলেরা সাগরে নামছেন ইলিশ ধরতে। তিনি আশা করছেন, এবার ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবেন জেলেরা।