চরফ্যাশনে করোনাকালে বেড়েছে শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ
নিজস্ব প্রতিবেদক।। বাংলাদেশের ১৮টি জেলার চেয়ে আয়তনের দিক থেকে দ্বীপ ভোলার উপকূলীয় উপজেলা চরফ্যাশন। ৯ টি বিচ্ছিন্ন চর আছে এখানে।
অধিকাংশ চরা অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংকট তার মধ্যে করোনা মহামারিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।
এই সময়ে দারিদ্র্য, দুর্দশা, যৌন হয়রানি এমন অসংখ্য কারণ দেখিয়ে অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের। এ তালিকায় ছেলে শিশু কিশোরদের নাম নেহাত কম নয়।
এসব বাল্য বিবাহের অধিকাংশ যেহেতু রেজিস্টার এর বাহিরে থেকে যাচ্ছে তাই সঠিক সংখ্যা যাচাই করা প্রায়শই অসম্ভব।
তথ্যসূত্র জানা যায়,করোনার ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মে পর্যন্ত পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসন, ৪ থানার পুলিশের হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়েছে মাত্র ৩৩ টি বাল্যবিবাহ।
বাল্যবিবাহের অপরাধে অভিযুক্ত অনেককে গুনতে হয়েছে জরিমানা বা কারান্ড। তার মধ্যে অনেক বাল্য বিবাহে রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিদের তদ্বীরও ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
বে-সরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্ট নামক এনজিও উপজেলার চরমাদ্রাজ ৩নং ওয়ার্ডকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমীণ ও চরমাদ্রাজ ইউপির চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক জমাদারসহ গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিথিতে বাল্য বিবাহ মুক্ত ঘোষণা করেছেন ২০১৯সালে।
ওই ঘোষণার এক মাসের মধ্যে একই ওয়ার্ডের ইউপির সদস্য অলিউল্যাহর মেয়েরই বাল্য বিবাহ হয়েছে।
এই বিষয় প্রশাসন ও কোষ্ট ট্রাস্ট প্রতিনিধি কোন উত্তর দিতে পারেননি। মুলতঃ বাল্য বিবাহ মুক্ত ঘোষণা করে দায়সারা কাজ শেষ করা হয়।
এর ফলোআপ বা জবাব দিহিতার কোন বালাই না থাকায় কর্মকাজ গুলো সাফল্য হয়না।
চরমাদ্রাজ ৩নং ওয়ার্ডের লামিয়া বেগম (১৪), চর নিউটন গ্রামের জমিলা(১৫), চর নাজিমুদ্দিন হেলাল সরকারের মেয়ে মুন্নী(১৩), চর নিজাম এর ঝুমুর(১৪) এমন অনেকের অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হয়েছে।
করোনা মহামারি বিশ্বব্যাপী বহু পরিবারকে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন। ফলে মেয়েদের মা-বাবারা মনে করছেন, মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে তাদের আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই বলেও অকের বক্তব্য।
এক্ষেত্রে নাবালিকার হবু স্বামীর বয়স নিয়ে তারা ভাবছেন না। বর্তমান পরিস্থিতি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে দীর্ঘ কয়েক দশকের সংগ্রামের অগ্রগতিকে রোধ করে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার হুমকি তৈরি করছে।
একটি বে-সরকারির জরিপের তথ্য মতে চরফ্যাশন উপজেলায় করোনার ১ বছর ৩মাসে প্রায় ২৮শতাংশ বাল্য বিয়ে হয়েছে। প্রশাসন বন্ধ করেছে ৫শতাংশ।
করোনাভাইরাসের বিস্তারের এ সময় বাল্যবিবাহের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গ্রামীণ পরিবারগুলোতে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিরা এ সময়টায় দেশে ফিরেছেন। সমাজ বাস্তবতায় প্রবাসে কাজ করা ছেলের ‘পাত্র’ হিসেবে চাহিদা বেশি। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এখন কম হচ্ছে।
সেই সুযোগও কাজে লাগাচ্ছে কেউ কেউ। সমাজের দরিদ্র অনেক অভিভাবকই এ সময় মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এ সময়টায় মানুষের চলা-ফেরা কমে গেছে। তাই খুব বেশি মানুষকে আপ্যায়ন করতে হচ্ছে না। এতে তাদের খরচও কমে যাচ্ছে।
লকডাউনে ঘরের মধ্যে পরিচিত মানুষের মাধ্যমে মেয়ে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার বেশি হচ্ছে। এই দিকটাও বাল্যবিবাহ দেওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে অনেক ক্ষেত্রে। মাতৃমৃত্যুর হার কমে আসা বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন।
দিনে দিনে বাল্যবিবাহ কমে আসায় কমছিলো মাতৃমৃত্যুর হার। করোনাকালে অভিভাবকের কাজ না থাকা, সন্তানের স্কুল খোলার নিশ্চয়তা না থাকা এবং অনিরাপত্তা বোধ থেকে বেড়েছে বাল্য বিবাহ।
নুরাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ বেগম বলেন, করোনা কালিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় ৬ষ্ট থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত ২১জন ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। তার মধ্যে অনেকে এখন শশুর বাড়ীতে বসাবাস করছে।
পৌর সভা ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইয়াছিন আরাফাত বলেন, বাল্য বিয়ের বিষয় ইউপির চেয়ারম্যান ও সচিবগন ডিজিটাল জম্ম সনদ প্রদান ও নিকাহ রেজিষ্টারগন সনদ ডিজিটাল দেখে অনলাইনের যাচাই- বাছাই করলেই বাল্য বিবাহ পরিমান হ্রাস পাবে।
সমাজকর্মী ও চরফ্যাশন সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ কয়ছর আহমেদ দুলাল বলেন, সচেতনতা ও আইন দিয়েই মূলত বাল্যবিবাহ রোধ করার প্রচেষ্টা চলছিল।
কিন্তু করোনাকালে বেড়ে গেছে বাল্য বিবাহ। মূলত: গ্রামাঞ্চলে চুপিসারে দেওয়া হচ্ছে এসব বিবাহ। ফলে বাল্যবিবাহের হার বেড়ে যাচ্ছে।
সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্রই এ সময়টিতে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন তিনি।
চরফ্যাশন সহকারী কমিশনার ভূমি বিপন বিশ^াস বলেন, কম বয়সে বিয়ে হলে সন্তান গর্ভে ধারণে স্বাভাবিক ভাবে শরীর ভেঙ্গে পড়ে।
সন্তান জন্ম হলে মায়ের শরীর ভেঙে পড়ে এবং সংসার বুঝেনা ফলে স্বামীর স্ত্রীকে ভাল বাসার পরিমান হ্রাস পায়। তখন সংসার বিচ্ছেদ হয়। এতে ওই সন্তান নানির কাছে রেখে মা‘ ঢাকায় গার্মেনসে চাকুরী করেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, বাল্য বিবাহের সংবাদ পেলে, সরাসরি উপস্থিত হয়ে আমারা বন্ধ করি। কেই আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনের আওতায় এনে জেল-জরিমানা করা হয়।