আয়-ব্যয়ে হরিলুট

দেশ জনপদ ডেস্ক | ০২:২৫, জুন ০২ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীর থ্রী হুইলার শ্রমিক ইউনিয়নের আয়-ব্যয়ে হরিলুট, যেনো দেখার কেউ নেই। সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও অফিস ভাড়ার নামে লোপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। শ্রম দফতরে দাখিলকৃত বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চালচিত্র। শ্রমিক সংগঠনের নামে লুটে-পুটে খাওয়ার এমন কর্মকান্ডের ব্যাপারে সভাপতি লিটন ও সাধারন সম্পাদক পরিমল ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে এড়িয়ে চলছে সংবাদমাধ্যমকে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানতে চাইলে বারবার দেখা করার কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। সংগঠনের আয়-ব্যয় নিয়ে কথা বলতে নারাজ উভয়েই। তবে এনিয়ে বরিশাল আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক ওসমান গনি বলেন, থ্রী হুইলার শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে আয়-ব্যয়ের যে রির্পোট প্রদান করা হয় সে সকল তথ্যাবলির উপরই আমাদের অনেকাংশে নির্ভর করতে হয়। কারন আমাদের জনবল সংকট থাকায় যাচাই বাছাইয়ের সুযোগ কম। কিন্তু সংগঠনগুলোর আয়-ব্যয়ের গড়মিল কিংবা দুর্ণীতি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয় তাহলে তদন্ত করা হবে কিনা জানতে চাইলে উপ-পরিচালক বলেন, অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে এবং সত্যতা পেলে ওই সংগঠনের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলাও হতে পারে। নগরীর নথুল্লাবাদস্থ টেম্পু স্ট্যান্ড ও চাঁদমারী এলাকায় থ্রি হুইলার সংগঠনের অর্থ লোপাটের ব্যাপারে প্রতিবাদমুখর না হয়ে বরং ভয়ে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলছে অধিকাংশ চালক ও শ্রমিক। এনিয়ে ভুক্তভুগীসূত্র জানায়, কমিটির এহেন কর্মকান্ডের ব্যাপারে কথা বললে নানা অজুহাতে সংগঠন থেকে বহিঃস্কার করা হয়। লাইনে গাড়ি চালাতে দেয়না এবং জোর করে চালাতে গেলে সংগঠনের লোকজন মারধর করে। এছাড়াও ট্রাফিক পুলিশকে ব্যবহার করে মামলা দেয়াসহ নানামুখী হয়রানি করা হয়। শুধু তাই নয়, আপনাদেরকে এই জিম্মিদশার কথা কোন চালক কিংবা শ্রমিক জানিয়েছে, তা জানতে পারলে তারও কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়। অপরদিকে থ্রি হুইলার সংগঠনের আয়-ব্যয়ে মোটা অংকের অর্থ লোপাট নিয়ে অনুসন্ধানসুত্রে জানা গেছে, বরিশাল জেলা ট্যাক্সি, অটোরিক্সা, অটো টেম্পু থ্রী হুইলার শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি নং ৫১৭) এর তিন বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ছিলো ১৫শ ১জন। নির্ধারিত সদস্যদের কাছ থেকে ওই অর্থ বছরে আয় হয়েছে মোট ৯০ লাখ ৬ হাজার টাকা। যেখানে কেবলমাত্র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ টাকা। বাকি ৩০ লাখ ৬ হাজার টাকা সংগঠনের বিভিন্ন কাজে যেমন সদস্যদের চিকিৎসা খরচ, পত্রিকা/সাময়িকী খরচ, সংগঠনের ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, আসবাবপত্র ক্রয়, আসবাবপত্র মেরামত, যন্ত্রপাতি ক্রয়, যন্ত্রপাতি মেরামত, সভা খরচ, আপ্যায়ন খরচ, যাতায়াত খরচ, ডিস বিল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে। আর বছর শেষে স্থিতি দেখানো হয়েছে মাত্র ৮৮০ টাকা। এরপর ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সংগঠনের সদস্য’র সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে ১৬’শ ৩০ জন। নির্ধারিত সদস্যদের কাছ থেকে ওই অর্থ বছরে আয় দেখানো হয়েছে ৯৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭২ লাখ টাকা। বাকি ২৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা সংগঠনের বিভিন্ন কাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর বছর শেষে পুনরায় স্থিতি দেখানো হয়েছে মাত্র ৮৮০ টাকা। সর্বশেষ ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও সদস্য’র সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬শ ৩০ জন। তবে করোনা মহামারির অজুহাতে আয় কমিয়ে সর্বমোট দেখানো হয়েছে ৪৮ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ওই অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। বাকি ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা সংগঠনের বিভিন্ন কাজে ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর বছর শেষে ফের স্থিতি দেখানো হয়েছে মাত্র ৮৮০ টাকা। অর্থ্যাৎ স্থিতি’র পরিমান পরপর তিন অর্থ বছরেই একই দেখানো হয়েছে। এদিকে ২০১৮-২০২০ সাল পর্যন্ত তিন অর্থ বছরে সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ মোট খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। যা কিনা সংগঠনের এক গুরুত্বপূর্ন কর্মকর্তা সাধারন সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাস কোন কিছুই অবগত নয় বলে জানান। এ সময় তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, ওরে বাবা এতো টাকা চোখেও দেখিনাই, বহু বছর ধরে সংগঠন করার পরেও। আমি কিছুই জানিনা ভাই, সব হিসাব-নিকাশ সভাপতি জানে। তবে সংগঠনের সভাপতি লিটন মোল্লা তার বক্তব্যে ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, তার এই ধরণের বক্তব্য সংগঠন বিরোধী। কারণ সংগঠনের বাৎসরিক আয়-ব্যয় বিবরণীতে তারও সীল স্বাক্ষর রয়েছে। তবে পরবর্তীতে যোগাযোগ করার জন্য ৩/৪দিন ক্রমাগত ফোন করলে তা রিসিভ করেননি। এহেন ধুরন্দিপনা দেখা গেছে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পরিমল চন্দ্র দাসের বেলায়ও। অথচ এই মোটা অংকের বেতনের ব্যাপারে খতিয়ে দেখতে গেলে প্রশ্নবিদ্ধতা তৈরী হয়। কি এমন কাজের বিনিময়ে সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা বেতন নিয়েছেন, তার কোন স্পষ্টতা খুজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সংগঠনের কর্মকর্তা-কর্মচারী কারা, যাদের বেতন বাবদ প্রতিবছর অর্ধকোটি টাকার বেশী খরচ দেখানো হয়েছে। এনিয়ে একাধিক শ্রমিক নাম অপ্রকাশের শর্তে বলেন, অফিসে তো কয়টা পুরানো চেয়ার আর টেবিল পরে আছে নিয়মিত কেউ অফিসও করেনা। আর এতো বেতন যে নেয় তারা কোন কাজের বিনিময়ে নেয় তাও জানিনা। আমরা শ্রমিকরা মাঝে মধ্যে কোন প্রকার বিপদগ্রস্থ হলে ঘটনাস্থলে গিয়ে লাইনম্যান বা সভাপতি-সম্পাদকসহ অন্যান্য সম্পাদকরা সমাধান করেন। সেক্ষেত্রে তাদের আসা-যাওয়ার খরচতো সংগঠনই ব্যয় করে। আর এ আসা-যাওয়াতো তেমন দূরেও না, যে অনেক টাকা যাতায়াত ভাড়া দিতে হবে। কারণ আমরাতো গাড়ি চালাই জেলা ও মেট্টোর মধ্যেই। তাহলে তারা কোন কাজের বিনিময়ে এই মোটা অংকের টাকা বেতন ভোগ করে তা আমরা জানিনা। আর বেতনের নামে যে এতো বড় অংকের টাকা হাতানো হয়েছে তাও আমরা জেনেছি আপনাদের মাধ্যমে। আগেতো জানতাম না। এদিকে গত তিন অর্থ বছরে মোট অফিস ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অথচ সরেজমিনে দেখা গেছে, নতুনবাজার পুলিশ ফাঁড়ির সামনে সংগঠনের নামে রয়েছে দোতলা বিল্ডিং এর একটি রুম এবং নথুল্লাবাদস্থ টেম্পু স্ট্যান্ড সিটি কর্পোরেশনের জায়গায় একটি টিনের ঘর। যেখানে দেখা মিলেছে ২ টি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার। অথচ এসব ঘর মেরামত বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। আর আসবাব পত্র ক্রয় বাবদ গত তিন অর্থ বছরে প্রায় ১ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। যদিও তেমন কোন আসবাবপত্রের দেখা মিলেনি। অপরদিকে সভা ও আপ্যায়নের নামে ওই তিন বছরে মোট খরচ দেখানো হয়েছে ৫ লাখ ৪০ হাজার ৬’শ টাকা। শ্রমিকদের সাহায্য ও চিকিৎসা বাবদ মোট খরচ করা হয়েছে ২৪ লাখ ২৯ হাজার ৮’শ টাকা। অথচ এ ব্যাপারে একাধিক শ্রমিক বলেন, গত দুই বছর সংগঠন থেকে কোন প্রকার সাহায্য পাইনি। তবে গত বছর করোনার সময় কিছু সাহায্য পেয়েছি। তবে তারা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, মাহেন্দ্র কিংবা থ্রী হুইলার চালাতে হলে প্রতিদিন সংগঠনের নামে বিশ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। আর চাঁদা না দিলে ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে হয়রানিমূলক মামলা দেয়। লাইনে গাড়ি চালাতে দেয়না। এরপর মারধর তো আছেই। এমন অসহায়ত্ব নিয়ে শ্রমিকরা আরো বলেন, আমরা লাইনম্যান বা কলম্যান ও অফিসের পিয়নরা যে টাকা দৈনিক পাই তা লজ্জ্বায় আপনাদের কাছে বলতে চাইনা। আপনারা আমাদের জীবনধারা দেখলেই বুঝবেন। ঠিকমতো বাসা ভাড়া দিতে পারিনা ও সন্তানদের খরচও যোগাতে পারিনা। কিন্তু সংগঠন থেকে ঠিকই প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা বেতন বাবদ ব্যয় হয়ে যায়। তাহলে এমন অর্থনৈতিক লোপাটের ব্যাপারে কি কখনো আপনারা প্রতিবাদ করেছেন জানতে চাইলে ভুক্তভুগী শ্রমিকরা আরো বলেন, ভাই প্রতিবাদ তো দূরে থাক। নেতারা যদি অনুমানও করে যে আমরা কেউ তাদের পক্ষের নই তাহলেও আমাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করবে। শুধু তাই নয়, এমনকি সংগঠন থেকেও বহিস্কার করে দিবে। এরপর মারধর তো আছেই। যেকারণে আমরা মেনেই নিয়েছি যে আমরা তিন চাকা চালাবো আর চাঁদা দিয়ে যাবো, এটাই আমাদের ভাগ্য। অপরদিকে, নগরীর চাঁদমারিস্থ এলাকায় বরিশাল জেলা মিশুক, বেবি ট্যাক্সি, ট্যাক্সি কার, সিএনজি (এলপি গ্যাস চালিত) শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি: নং ২২৫৬) সংগঠনটিতে ২০১৮ সালের অর্থবছরে ১শ ১৪জন সদস্যর বিপরীতে আয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা। অপরদিকে ২০১৯-২০ সালের অর্থ বছরে ওই একই সদস্য সংখ্যার বিপরীতে আয় হয়েছে ১০ লাখ ২৬ হাজার টাকা। অর্থ্যাৎ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা একই থাকার পরও দুই অর্থ বছরের আয়ের বিবরণীতে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে ২২৫৬ সংগঠনের সভাপতি এসএম হুমায়ুন কবির ও সাধারণ সম্পাদক সবুজ জোমাদ্দারের সাথে একাধিকবার মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এরপর তাদের সংগঠনের অফিস কার্যালয়ে গিয়েও তাদের দেখা মেলেনি। তবে সংগঠনের দুর্নীতি নিয়ে বিস্তারিত আসছে পরবর্তী পর্বে ।