৭০ বার বলা হলো ‘তদন্ত চলছে’

কামরুন নাহার | ০৩:৩১, ফেব্রুয়ারি ১০ ২০২০ মিনিট

বিগত আট বছরেও নেই অগ্রগতি। হতাশায় সময় কাটছে পরিবারের। কারো কিছু জানা নেই। স্বজনদের তথ্য দিচ্ছে না র‌্যাব। ‘চেষ্টা চলছে’ জানিয়ে আদালতে র‌্যাবের সময় প্রার্থনা বারবার। মামলার অগ্রগতি জানাতে সময় চাওয়ার সেই সংখ্যা দাঁড়াল ৭০। চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যা মামলার অগ্রগতি সেই একই বৃত্তে সীমাবদ্ধ। ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধী গ্রেপ্তার’—তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই আশ্বাসের পর আট বছর কেটেছে। আগামীকাল ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি খুনের আট বছর পূর্ণ হচ্ছে। হতাশার আরেকটি বছর কাটল স্বজনদের। দুই সন্দেহভাজন খুনিকে শনাক্তের কথা বলে ৭০ বার আদালতে সময় প্রার্থনা করলেও র‌্যাব কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। শেষ দফায় আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের দিন নির্ধারিত আছে আজ সোমবার। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু অগ্রগতি আছে। খুনি শনাক্তের চেষ্টা আছে বলেও দাবি র‌্যাবের। তবে সাগর-রুনির স্বজন ও সহকর্মীরা বলছেন, তদন্ত একেবারে স্তিমিত হয়ে পড়ে আছে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ। এ সময় বাসায় ছিল তাঁদের একমাত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। ঘটনাস্থলে গিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার’ মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে। দুই দিন পর তৎকালীন পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তখন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দুই মাস তদন্তের পর ‘ব্যর্থতা’ জানালে আদালত র‌্যাবকে তদন্তভার দেন। তারা সাত বছর ১০ মাস ধরে তদন্ত করছে। এ সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে ৭০ বার সময় প্রার্থনা করেন র‌্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা। গত ৩০ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাসের আদালত ৭০ বারের মতো সময় বাড়িয়ে আজ (১০ ফেব্রুয়ারি) তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেন। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, র‌্যাবের ৬৯টি অগ্রগতি প্রতিবেদনেই ‘গুরুত্বসহকারে তদন্ত চলছে’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২০০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করার কথাও বলা হয়েছে। সন্দিগ্ধ আসামিদের তালিকা প্রস্তুত করে তাদের নাম ও ঠিকানা যাচাই এবং পূর্ব ইতিহাস জানার জন্য গতিবিধি, চাল-চলন গভীর ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। ডিএনএ প্রতিবেদন পাওয়ার কথা বলা হলেও চুরি যাওয়া ল্যাপটপ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড়, সাগরের হাত-পা যে কাপড় দিয়ে বাঁধা হয়েছিল সেই কাপড় ও রুনির পরনের টি-শার্ট পাঠানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে।২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দাখিল করা এক প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার রিপোর্টগুলো পাওয়া গেছে। সে রিপোর্ট ও অপরাধচিত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনায় দুজন পুরুষের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রফাইল পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারকৃত আট আসামি, নিহত দুজন এবং স্বজন মিলে ২১ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছিল। এসব পরীক্ষায় সন্দেহভাজন খুনি শনাক্ত হয়নি। এই মামলায় গ্রেপ্তারকৃত আটজনের মধ্যে পাঁচজন—রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুণ মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তার দেখানো হয় পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীর। এদের মধ্যে তানভীর, মিন্টু ও পলাশ হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছে। বাকিরা এখনো কারাগারে আছে।মামলার বাদী ও রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বল্ন, ‘এখন কী তদন্ত হচ্ছে তাও আমাদের জানা নেই। গত এক বছরের মধ্যে একবার শুধু আইও (তদন্ত কর্মকর্তা) ফোন দিয়েছিলেন। এ ছাড়া কিছু জানি না।’র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, ‘মামলার তদন্ত চলছে। কিছু বিষয়ে অগ্রগতিও আছে। পরে এ বিষয়ে আমরা জানাব।’ মা-বাবা খুনের সময় পাঁচ বছরের মেঘের বয়স এখন ১৩ বছর। রাজধানীর ইন্দিরা রোডে নানার বাসায় মামার সঙ্গে থাকছে সে। গুলশানের একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে মেঘ। এবার বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ক্রিকেট বিভাগে ভর্তির আবেদন করে ক্যাম্পেও গেছে মেঘ। স্বজনরা জানায়, সাকিবের মতো বড় ক্রিকেটার হতে চায় মেঘ। চিকিৎসকের পরামর্শে স্বজনরা মেঘকে মা-বাবার স্মৃতি আঁকড়ে থাকতে দেন না। তবে প্রায় মা-বাবার কথা বলে সে। এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ভিন্ন মামলায় মেহেরুন রুনির পরিচিত শান্ত ওরফে ডন ও তার সহযোগী সারোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে সম্প্রতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাগর-রুনি খুনের সঙ্গে এরা জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখছে সিআইডি। ডন ও সারোয়ারের আরেক সহযোগীকেও খুঁজছে সিআইডির তদন্তকারীরা। অন্যদিকে দীর্ঘ আট বছরেও খুনের রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে সাগর-রুনির সহকর্মীদের মধ্যে। তাঁরা বলছেন, প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবেই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে না। বিচারের দাবিতে আগামীকাল ঢাকা রিপোর্টার ইউনিটি (ডিআরইউ) চত্বরে মানববন্ধন সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবেন সাংবাদিকরা।মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তাপ্রধান রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, ‘এই ঘটনা আমাদের জন্য চরম হতাশার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনিদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। অথচ আট বছরেও তদন্ত করে খুনের মোটিভও আমাদের জানাতে পারেননি কেউ। প্রতি মাসে একবার আদালতে সময় নেওয়ার ঘটনা আমাদের কাছে কাটা ঘায়ে লবণের ছিটার মতো। আমি মনে করি, এর পেছনে বড় কোনো রহস্য আছে। এখন রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির জন্যই এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হওয়া জরুরি।’