ভোলায় জেলেদের জন্য বরাদ্ধের চাল বিতরনে অনিয়ম

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২২:১৯, মে ২৩ ২০২১ মিনিট

ভোলা প্রতিনিধি ॥ ভোলায় জেলেদের মাঝে ভিজিএফ চাল কম দেয়া এবং আত্মসাতসহ ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলে প্রতি ৮০ কেজির স্থলে ৩৫ কিংবা ৩৮ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। অতিরিক্ত চাল বিতরন না করেই রেখে দেয়া হচ্ছে সরকারী গুদামে। জেলে কার্ড নয়, নিজস্ব কার্ড ছাপিয়ে বিতরন করতে দেখা গেছে চাল। অনিয়মের তদন্ত করে দেখার কথা জানানো হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। বছরের মার্চ এপ্রিল এ দুই মাস মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। যে কারনে এসব কর্মহীন অস্বচ্ছল জেলেদের জন্য সরকার ৪ মাস প্রত্যেক জেলে পরিবারকে ৪০ কেজি করে ৪ মাসে ১৬০ কেজি ভিজিএফ চাল দেয়। স্থানীয় ভাবে প্রতি মাসে বিতরন করা হচ্ছে না। দুই মাস পর পর ৮০ কেজি করে চাল বিতরন করার কথা থাকলেও স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বাররা স্থানীয় প্রশাসন ম্যানেজ করে ৮০ কেজির স্থলে ৩৩ কিংবা ৩৫ কেজি করে চাল দিচ্ছে। সরেজমিন ভোলার দৌলতখানের চরপাতা ইউনিয়ন চাল বিতরনের খবর পেয়ে গেলে নজরে আসে ৮০ কেজির স্থলে ৩৩ কিংবা ৩৫ কেজি করে দিচ্ছে দুই মাসের চাল। আবার এর চেয়েও কম চাল দেয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। একমাসে ১শত সাড়ে ১২টন চাল বিতরন করার কথা থাকলেও ৯৫ টন চাল উত্তোলন করে বিতরন করে। শুধু তাই নয়,সাদা বস্তায় করে নিয়ে যাচ্ছে মেম্বারসহ তাদের লোকজন। চাল কম দেয়া ও কম উত্তোলন করার কথা স্বীকার করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো: হেলাল উদ্দিন বলেন, একটি ডিউয়ের (একমাস) চাল উত্তোলন করেছি। দুইমাসের দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি। একই সুরে কথা বলেন পরিষদের উদ্যোক্তা অরুন চন্দ্র হাওলাদার। মাস্টাররোল দেখতে চাইলে দ্রুত সেটি না দেখিয়ে সরিয়ে ফেলেন। এ সময় দেখা যায় অটোরিক্সায় করে ১০/১২ টি সাদা বস্তায় ভরে চাল সরিয়ে নিচ্ছে। যার একটি রিক্সাকে থামালে গ্রাম পুলিশ সরে যায়, আর রিক্সা চালক বলেন, আমার কি দোষ ? আমি বাড়িতে দিয়ে আসলে মেম্বাররা টাকা দিবে। অপরদিকে তজুমদ্দিন উপজেলার মলংচড়া ইউনিয়নে লাইন দিয়ে চাল নিচ্ছে জেলেরা। সরকারী ভাবে দেয়া জেলে কার্ড না দেখে স্থানীয় ভাবে ছাপিয়ে তার মাধ্যমে চাল বিতরন করছে মেম্বারসহ উপজেলা নির্বাহী প্রতিনিধি (ট্যাগ অফিসার)সহ সকলেই। সেখানে একজনের হাতে ২/৩টি করে স্লিপ দেখা গিয়েছে। এছাড়া এসব টোকেন বা স্লিপে নাম না লিখে শুধু নাম্বার লিখে দিচ্ছে যাতে একই জনের ২/৩টি বুঝা যাতে না যায়। ক্যামেরা দেখেই সেখানে দুইমাসের চাল হিসেবে বিতরন করা হচ্ছে ৩৮ কেজি করে। তবে জেলেরা বলছে ৩৩ থেকে ৩৫ কেজি করে চাল দিচ্ছে তাদের। এসব চাল বিতরন না করে পরবর্তীতে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। এসব বিষয় তজুমদ্দিন উপজেলার মলংচরা ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ড মেম্বার বশির উল্ল্যাহ বলেন, তারা যেসব জেলেদের নামে চাল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং যাদের নামে বরাদ্ধ হয়নি তাদেরকেও চাল দিচ্ছে। একই সাথে বিশেষ টোকেন সম্পর্কে বলেন, তাদের সুবিধার জন্য তারা এটা করেছে। এভাবেই তারা চাল দিয়ে থাকে। কম কেন দিচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, কম দিচ্ছি এজন্য যে আমাদের খরচ আছে। কথা বলার এক পর্যায়ে তাদেরই মাস্তান টাইপের কিছু লোক এসে বাধা সৃস্টি করে। তারা কাজে বাঁধা দেয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিনিধি ট্যাগ অফিসার তজুমদ্দিন উপজেলায় কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাসিম উদ্দিন বলেন, ৩৮কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। দুই মাসেরটা একসাথে দেয়া হচ্ছে। আর দেয়া হবে না। এটাই শেষ দেয়া। ৮০কেজির স্থলে কেন ৩৮ কেজি দেয়া হচ্ছে। তখন ই তিনি বলেন, চেয়ারম্যান মেম্বাররা যে ভাবে বলেছে সেই ভাবে দিচ্ছি। অনিয়ম না নিয়ম জানতেই তিনি বলেন, আমি নতুন। এটা আমি গিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করবো। এ সময় ৮ নং ও ৯নং ওয়ার্ড এর চাল নিতে আসা জেলেরা মিথ্যা বলার প্রতিবাদ করে বলেন, আমরা ৩৮কেজি পাই না। আপনাদের দেখে ৩৮ কেজি দিচ্ছে। আমাদেরকে ৩৩ ও ৩৫ কেজি করে দিচ্ছে। এসব জেলেদের কথার সত্যতা পাওয়া গেছে, মলংচরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরনবী সিকদার এর সাথে কথা বলে। মুঠোফোনে বলেন, আমি যা করছি আইনের মধ্যে থেকেই করছি। ৩০ কেজি আর ৩৩ কেজি দিচ্ছেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ৩৩ কেজি না আমিতো ৩৫ কেজি করে দিয়েছি আইনের মধ্যে থেকেই। দুই মাসে প্রত্যেক জেলে পরিবার ৮০ কেজি চাল পাবে,তা হলে কেন ৩৫ কেজি দিচ্ছেন, বলার সাথে সাথেই বলেন, আইনের মধ্যে থেকেই করছি। এখন আমি ঢাকা যাচ্ছি, ভোলার পথে। পরে কথা বলবো। সুশাসনের জন্য নাগরিক ভোলা জেলার সভাপতি মোবাশ্বীর উল্লাহ চৌধুরী এসব অনিয়মকে সুষ্ঠ তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবী জানিয়েছেন। তিনি বলেন,সরকার অসহায় হতদরিদ্র জেলেদের জন্য ভিজিএফ দিচ্ছে, তখন অসাধু চেযারম্যান, মেম্বার ও সরকারী কর্মকর্তারা তা লুটে খাচ্ছে যা খুবই দুংখজনক। এসব বিষয় এর আগে বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা বরখাস্ত হয়েছে,তার পরেও হচ্ছে না। দায়ীদের বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন বলে তিনি আশা করেন। এসব বিষয় জানার জন্য দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে গেলে সেখানে তার সামনে দৌলতখান মৎস্য কর্মকর্তা, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এর সামনে দৌলতখান খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শান্তি রঞ্জন দাস সকলেরই সামনে স্বীকার করেন, যে চরপাতা ইউনিয়নে ৯৫ টন চাল নিয়েছে। বাকী ১৩০ টন চাল গুদামে রয়েছে। পরবর্তীতে তাকে গুদামে গিয়ে পাওয়া যায়নি, তিনি দ্রুত সেখান থেকে সটকেপড়েন। দৌলতখান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ তারেক হাওলাদার বলেন, আমি একসাথে একই তারিখে একই সময় দুই মাসের ডিউওতে স্বাক্ষর করেছি। একমাসের চাল নেয়ার কথা নয়। কাগজ এর বাহিরে কথা বলার সুযোগ নেই। প্রত্যেক জেলে পরিবার ৮০ কেজি করে পাবে। তাদেরকে কম দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন, পরে যে মাস্টার রোল থাকবে সেটা আমাদের কাছে সাবমিট করবে। যে বিষয়টি অভিযোগ এসেছে সেটি তদন্ত করে দেখবো। জেলা সৎস্য কর্মকর্তা এসএম আজহারুল ইসলাম,বল্লেন,এর আগেও বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এসব অভিযোগে সাসপেন্ড হয়েছে। অভিযোগ পেয়েছি, আমরা এসব বিষয় খোজ নিচ্ছি। তবে কম দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা। এক পর্যায়ে তিনি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাদের ফোন করে ঘটনার সত্যতা পেয়ে তদারকি বৃদ্ধি করার নির্দেশ দিয়েছেন। একই সাথে যারা অনিয়ম করে কম দিচ্ছে,তাদের বিষয় তদন্ত করার কথা জানালেন। আরো জানালেন, চরপাতায় যে কম দিয়েছে সেখানে এখন ৮ কেজি করে দিবে আর বাকীদেরকেও দেয়া হবে। এছাড়া তজুমদ্দিনের মলংচরার বিষয় খোজ নিয়ে জানানোর নির্দেশ প্রদান করেন। অপরদিকে ভোলার জেলা প্রশাসক মো: তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন,আপনি আমাকে বলার সাথে সাথেই ইউএনওকে বলেছি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। জেলেদের চাল কম দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এমন অনিয়ম মেনে নেয়া হবে না।