লঞ্চ মালিকরা ভাসছেন হতাশার সাগরে

দেশ জনপদ ডেস্ক | ০৯:১৭, মে ১২ ২০২১ মিনিট

বিশেষ প্রতিবেদক ।। বাস, ট্রাক, ছোট গাড়ি, বিমান- সবই তো চলছে। বন্ধ শুধু লঞ্চ। এই যে ফেরিতে গা ঘেষাঘেষি করে হাজার হাজার মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন তাতে করোনা ছড়ানোর ভয় নেই? তাহলে কি ধরে নেব যে করোনা শুধু লঞ্চেই ছড়ায়?’ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন লঞ্চ মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু। করোনার কারণে টানা ১ বছরেরও বেশি সময় ধরে নানা বিধিনিষেধ আর দফায় দফায় লকডাউনের ফলে বিপর্যস্ত তার ব্যবসা। শুধু রিন্টুই নন, সব লঞ্চ মালিকেরই এখন এ একটি প্রশ্ন। সারা বছর লাভ-লোকসানের মিশেলে লঞ্চ চললেও মালিকের টার্গেট থাকে ঈদ। বছরের দুটি ঈদে যে সংখ্যক যাত্রী লঞ্চে ভ্রমণ করেন তা দিয়েই সারা বছরের হিসাব মিলিয়ে নেন তারা। কিন্তু এ বছর তা হচ্ছে না। ফলে ক্ষোভের পাশাপাশি চরম হতাশা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে তাদের। কথা হচ্ছিল বরিশাল লঞ্চ মালিক সমিতির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রিয়াজ উল কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বরিশালের অভ্যন্তরীণ ৮টি রুটে চলাচল করে ৪১টি লঞ্চ। শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৪শর বেশি। গেল বছর করোনার কারণে লকডাউনে টানা ৭২ দিন বন্ধ ছিল লঞ্চ। এবার আবার ১ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রায় ১০ দিন হতে চলল লকডাউনের বেশ কিছু নিয়মবিধি শিথিল করেছে সরকার। বিমান চলছে। জেলার অভ্যন্তরে বাস চলাচলের অনুমতির সুযোগে জেলার সীমান্ত পর্যন্ত বাস চালাচ্ছেন মালিকরা। মানুষ জেলার সীমান্তে গিয়ে আবার পরের জেলার বাস ধরে ভেঙে ভেঙে পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে। রাজধানী ঢাকা থেকে ট্রাক কিংবা পিকআপেও যাচ্ছেন বাড়ি। যারা একটু সামর্থ্যবান তারা আবার গন্তব্যে পৌঁছুচ্ছে প্রাইভেট কার কিংবা মাইক্রোবাস ভাড়া করে। কোনো কিছু কি বন্ধ আছে? বন্ধ আছে শুধু লঞ্চ। এর মানে কি এই যে, লঞ্চ চললেই করোনা ছড়াবে, অন্য কোনো যানবাহনে নয়? সরকার তো পারত বাসের মতো আমাদেরও অন্তত জেলার অভ্যন্তরে লঞ্চ চালানোর অনুমতি দিতে। কিন্তু সেটুকুও দেওয়া হলো না।’ রিয়াজ উল করিমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তিনি বরিশাল লঞ্চ মালিক সমিতির অফিসে শ্রমিক-কর্মচারীদের দিচ্ছিলেন ঈদের বোনাস। মালিক সমিতির সঞ্চিত অর্থ থেকে দেওয়া হচ্ছিল এ সহায়তা। টাকা পাওয়া শ্রমিক রফিকুল ইসলামকে কত টাকা পেলেন জিজ্ঞেস করতে তিনি বলেন, ‘যা পেয়েছি আলহামদুল্লিলাহ। মালিকরা টাকা দেবেন কোথা থেকে? মাসের পর মাস লঞ্চ বন্ধ থাকলে লোকসানটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা আমরাও বুঝি।’ অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী এমএল টাইপের ছোট লঞ্চগুলোর শ্রমিক-কর্মচারী ঈদ সহায়তা হিসাবে কিছু টাকা মালিকদের কাছ থেকে পেলেও চরম বিপদে আছেন ঢাকা-বরিশালসহ দূরপাল্লার রুটের ডবল ডেকার লঞ্চগুলোর শ্রমিকরা। হাতেগোনা ২-৪টি কোম্পানি কিছু টাকা দিলেও অধিকাংশ মালিকই রাখছেন না শ্রমিকদের কোনো খবর। ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে চলাচলকারী সুরভী নেভিগেশনের পরিচালক রেজিন উল কবির বলেন, ‘বিষয়টি যে আমরা জানি না তা নয়। তবে কি করার আছে বলুন? আমরা যতদূর পারি আমাদের কোম্পানির শ্রমিক-কর্মচারীদের সহায়তা করছি। কিন্তু এমন মালিকও আছেন যারা লঞ্চ চললে সংসার চালাতে পারেন। না চললে করতে হয় ধারদেনা। অধিকাংশ মালিকেরই রয়েছে বিশাল অঙ্কের ব্যাঙ্ক ঋণ। করোনার জন্য লঞ্চ বন্ধ রেখেছে সরকার। কিন্তু ঋণের কিস্তি নেওয়া তো বন্ধ হয়নি। এমনও মালিক রয়েছেন যারা পাওনাদার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।’ ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী কীর্তনখোলা লঞ্চের মালিক মঞ্জুরুল আহসান ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত যাত্রী টানি মাথাপিছু মাত্র ২৫০ টাকায়। বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, যারা ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের একজনকেও আটকে রাখতে পেরেছে সরকার? বরঞ্চ ভেঙে ভেঙে রাজধানী থেকে বরিশাল পর্যন্ত আসতে একেকজনের খরচ হয়েছে হাজার/দেড় হাজার টাকা। এই যে ফেরি বোঝাই হয়ে হাজার হাজার মানুষ এসেছেন তাতে কি স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা হয়েছে? জনতার চাপে শেষ পর্যন্ত ফেরি চলাচল স্বাভাবিক করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। তারপরও কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা যায়নি। সবকিছুই যখন সরকার স্বাভাবিক করে দিল সেখানে লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দিলে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো?’ এফবিসিসিআইর পরিচালক, বরিশাল মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট এবং অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চ কোম্পানির মালিক নিজামউদ্দিন বলেন, ‘গেল বছর করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবারও এ বছর ঘাটে নোঙ্গর করিয়ে রাখা হলো লঞ্চ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চালানোর ক্ষেত্রে ভাড়া ৬০ শতাংশ বাড়ানো হলেও সেই সুযোগ গত বছর পাইনি আমরা। অথচ আমরাও কিন্তু সরকারের নির্দেশনা মেনে অর্ধেক যাত্রী নিয়েই লঞ্চ চালিয়েছি। এ বছর আমাদেরকে সুযোগটি দেওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল লঞ্চ। করোনার ধাক্কা সামলাতে প্রায় সব সেক্টরের শিল্প মালিকদের প্রণোদনা দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রেও বঞ্চিত হয়েছি আমরা। প্রণোদনা কিংবা বিশেষ সহায়তা, কোনো কিছুই দেওয়া হয়নি আমাদের। সরকারিভাবে সহায়তা দেওয়া হবে উল্লেখ করে শ্রমিক-কর্মচারীদের নামের তালিকাসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেওয়া হলো। অথচ সেখান থেকেও পাওয়া গেল না কিছুই। সারা দেশে সবকিছু চলছে। শুনছি রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় যাত্রী পরিবহণ করছে দূরপাল্লার বাসগুলো। অথচ হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে আমাদের। এখন আপনারই বলুন, আমরা কি করব? কোথায় যাব?’ বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন- ‘বিমানে ৩ হাজার টাকার টিকিটের দাম এখন ১০ হাজার টাকায় উঠেছে। বিত্তশালীরা ৩ গুণেরও বেশি টাকা দিয়ে বিমানে আসছেন বাড়িতে। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তারাও খুব সহজেই আসতে পারছেন। দেশের কোনো এলাকায় যেতে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন না কেউ। কপাল পুড়েছে শুধু বরিশাল অঞ্চলের মানুষের। সবকিছু যখন চলছে তখন লঞ্চ ছেড়ে দিলে খুব কি ক্ষতি হতো? অন্তত মাত্র ২৫০ টাকায় বাড়ি ফিরতে পারতেন দক্ষিণের ৬ জেলা আর ৪৪ উপজেলার মানুষ। আমার কথা হচ্ছে, চলাচল আটকাতে চাইলে সরকারের উচিত ছিল সব সেক্টর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা। আজ ফেরি ঘাটে হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখে সবাই করোনার ভয়ে আতঙ্কিত। কিন্তু বাস-ট্রাক-পিকআপ আর ভাড়া করা গাড়িতে যারা রাজধানী থেকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাচ্ছেন তারা করোনা ছড়াবেন না? করোনা কি শুধু বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষই ছড়াবেন? আসলে সরকারে থেকে যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন তাদের দূরদর্শিতা কতটুকু সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।’ সূত্র: যুগান্তর