জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিকূলতায় উপকূল

দেশ জনপদ ডেস্ক | ১৬:৪২, এপ্রিল ২৮ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥  জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদের ১৪ জেলার তিন কোটি ৩৯ লাখ দুই হাজার ৯৪৩ জন মানুষসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। ভৌগোলিকভাবে উপকূল বাংলাদেশ সব সময়ই বিপদাপন্ন। বাংলাদেশের কৃষি মূলত আবহাওয়া ও জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতি নির্ভর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মাত্রাও কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর বিরূপ প্রভাব। এর প্রভাবে ভূ-মন্ডলের জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ও এর গতি প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে, আবহাওয়ার ধরন এবং ঋতু বৈচিত্র্য পাল্টে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রের উষ্ণায়ন, বিশ্ব পানিচক্র, তুষারপাত, বরফগলা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুজনিত দুর্যোগগুলোকে মানবসৃষ্ট প্রভাব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইন্টার গভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) তথ্যানুযায়ী জলবায়ুর পরিবর্তনে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দুটোই বাড়বে এবং অসম বৃষ্টিপাত হবে। কখনও কখনও অনাবৃষ্টি থাকবে। বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ফসল উৎপাদন, পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য, তাপপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি, উপকূলীয় জলোচ্ছ্বাস, বরফগলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রভাব পড়বে। বিশ্ব গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং পানিচক্রে অসমতা পরিলক্ষিত হবে। ইউএনডিপি বাংলাদেশকে বিশ্বের এক নম্বর গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাইক্লোনপ্রবণ এবং ষষ্ঠতম বন্যাপ্রবণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অসম বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিক্ষয়, জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি, খরা, টর্নেডো, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাসের প্রাদুর্ভাব ও মাত্রা বৃদ্ধি, উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শীত মৌসুমে হঠাৎ শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা, আকস্মিক বন্যা ইত্যাদি এ দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছে, যা মানবকল্যাণ ও জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনযাত্রা এবং খাদ্য নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিরূপ পরিস্থিতির সাথে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করে জলবায়ু পরিবর্র্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো, দুর্যোগমুক্ত সময়ে শস্য বহুমুখীকরণ ও ফসলের নিবিড়তা বাড়িয়ে দুর্যোগের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া বিশেষভাবে বিবেচ্য। এ রকম অবস্থায় দেশের খাদ্য ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন উপযোগী কলাকৌশল ও সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বেড়ে গেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর পানির উৎসসমূহ বিষাক্ত করে তুলেছে। মিঠা পানির বিভিন্ন নদীতে লবণাক্ত দেখা দিয়েছে। উপকূলের বলেশ্বর, মধূমতি, মাতামুহুরি, পায়রা, বিষখালী, সন্ধ্যা, কচা, সুগন্ধা, কির্ত্তনখোলা, তেতুলিয়া, আগুনমুখা, আন্ধারমানিক, নবগঙ্গা, চিত্রাসহ ৫৭টি খরস্রোতা নদীর পানিনে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে গেছে। এসব খরস্রোতা নদীগুলোতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে পূর্ণিমা, অমাবশ্যা ও জোয়ার চলাকালীন সময়ে। সিইডি, সিসিএফডি, সিআরআইডি ও সিএমপিডি’র তথ্যানুযায়ী, উপকূলের ৫৭টি স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে পরীক্ষা করা দেখা গেছে ভূ-গর্ভস্থ পানির ৮২ দশমিক ১৪ শতাংশ ক্ষতিকারক এবং ৩৩ দশমিক ৫০ শতাংশ পানি অত্যন্ত ক্ষতিকারক। উপকূলীয় অঞ্চলে গত ছয় মাসে খরা ও অনাবৃষ্টির কারণে লবণের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে শুকনো মৌসুমে বোরো ধান ও অন্যান্য রবি শষ্য সেচের মাধ্যমে চাষাবাদ করতে হয়। পানির লবণাক্ততা ও ক্ষতিকারক উপাদান বিদ্যমান এলাকায় লবণ সহিষ্ণু ধান উৎপাদন না করলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে। গবাদি পশুর ঘাস উৎপাদন হবে না। নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলো সরাসরি চাষাবাদের জমির সঙ্গে সংযুক্ত। উপকূলীয় এলাকায় খালগুলোতে চাষাবাদের সুবিধার্থে স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে রয়্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আব্দুর রহমান খোকন বলেন, ‘লবণাক্ত পানি খাল বা নালা থেকে জমিতে প্রবেশ যাতে না করতে পারে সে জন্য যথাসময় স্লুইসের গেট বন্ধ এবং খোলা রাখা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর প্রভাব ও লবণাক্ততার কারণে উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্যেও বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য রক্ষার্থে সরকারের সুনির্দিষ্ট ও পরিকল্পিত আলাদা বাজেট প্রণয়ন করা দরকার।’