নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল পাসপোর্ট অফিসে সোজা পথে ভোগান্তি আর দালালে প্রশান্তি। এমন বাক্য যেন চিরন্তন সত্যে পরিনত হয়েছে। দালাল সদস্যদের আনাগোনা বছর জুড়েই চলতে থাকে এ দপ্তরে। তবে এবার যোগ হয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় অসাধু সদস্যরা। পাসপোর্ট অফিসে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত কিছু আনসার এবং পুলিশ সদস্যরাই গড়ে তুলেছে তাদের দালালির নেটওয়ার্ক।
সরকারি এই দপ্তরে জনভোগান্তির নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রক পুলিশ সদস্য রাসেলসহ কিছু অসাধু আনসার সদস্য। পাসপোর্ট করতে আসলেই ওঁৎ পেতে থেকে ধরে নিয়ে যায় তাদের ডেরায়। এরপর নানা বাক্যের ফুলঝুঁড়ি ছড়িয়ে সহজেই পাসপোর্ট পাবার আশ্বাস দেখিয়ে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। যে কারণে সরাসরি পাসপোর্ট করতে ভোগান্তির কথা চিন্তা করে দালালের হাতে তুলে দেয় কাগজপত্রসহ চুক্তির টাকা।
সরেজমিনসূত্রে, সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে কমপক্ষে দুই থেকে তিন হাজার টাকা বেশি দিয়ে পাসপোর্ট করতে হচ্ছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। আর বাড়তি এ টাকা পাসপোর্ট দপ্তরের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সকল টেবিলে তা ভাগ হয় দৈনিক ভিত্তিতে। তবে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা আবেদন প্রতি ৫’শ থেকে ৮’শ টাকা হাতিয়ে নেয়। বাকি টাকা সহকারি পরিচালকসহ অন্যান্য টেবিলের জনবলদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়।
সূত্রে আরো জানা গেছে, করোনাকালীন সময়ে প্রতিদিন প্রায় ১শ’ আবেদন জমা পরতো পাসপোর্ট দপ্তরে। কিন্তু মহামারির আগে প্রতিদিন পাসপোর্ট দপ্তরে প্রায় দেড়শ/২শ’ আবেদন জমা পরতো পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। সূত্রে আরো জানা গেছে, পাঁচ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য নরমাল ফি ৪ হাজার ২৫ টাকা, ১০ দিনের মধ্যে ৬ হাজার ৩শ’ ২৫ টাকা, দুই দিনের মধ্যে ৮ হাজার ২৫ টাকা। এবং দশ বছর মেয়াদি পাসপোর্টের জন্য নরমাল ফি ৫ হাজার ৭শ’ ৫০ টাকা ও একই মেয়াদে ১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারি ফি ৮ হাজার ৫০ টাকা এবং দুই দিনের মধ্যে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা। এই মূল্যমানের পাসপোর্টগুলো ৪৮ পৃষ্ঠা সম্বলিত। তবে ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট ফি আরো বেশি।
অথচ দালালরা সরকারি ফি’র চেয়েও প্রতি পাসপোর্ট বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এ হিসেবে দৈনিক প্রায় লক্ষাধিক টাকা ঘুষ বাণিজ্য হয় পাসপোর্ট দপ্তরে। আর এর বেশীরভাগ লেনদেনই হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্য দিয়ে। কারন হিসেবে জানা গেছে, পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতিনিয়ত অফিসের সামনেই ডিউটি পালন করতে হয়। আর এ সুযোগেই তারা বিভিন্ন পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের গুছিয়ে নিজেদের সিন্ডিকেটের জালে সইজেই আটকাতে পারে।
এনিয়ে অনুসন্ধানসূত্রে আরো জানা গেছে, প্রতিদিন যে কয়টি আবেদন জমা পরে তারমধ্যে প্রায় ৩০/৫০ টি আবেদন সরাসরি জমা নিতে বাধ্য হয় দপ্তরটি। বাকি আবেদন আনসার ও পুলিশের দালালির মাধ্যমেই পাসপোর্ট দপ্তরে জমা পরে। আর প্রতিটি আবেদনে সরকার নির্ধারিত ফি’র চেয়ে ২-৩ হাজার টাকা বেশি নেয়ার কারণে দৈনিক প্রায় লক্ষাধিক টাকা ঘুষ লেনদেন করে আনসার ও পুলিশ সদস্যরা।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদস্য রাসেল বলেন, ভাই অনেক সময় উর্ধ্বতন স্যারদের রেফারেন্স থাকে তখন আবেদনকারীকে সহায়তা করতে হয়। কিন্তু আপনিতো যেকোন আবেদনকারী আসলেই ওঁৎ পেতে থেকে নিয়ে যান আপনাদের অন্যান্য সদস্যদের কাছে। এরপর বাধ্য করেন আপনাদের মাধ্যমে আবেদন জমা দিতে। গতকালও আপনি এ কাজটি করেছেন বললে রাসেল আরো বলেন, আমি এ কাজ করি না।
অপরদিকে উক্ত পাসপোর্ট দপ্তরের এক আনসার সদস্য গতকাল এক পাসপোর্ট আবেদনকারীর কাছে দেড় হাজার টাকা ঘুষ চেয়ে ফেঁসে যায়। ভুক্তভোগী আবেদনকারী সাংবাদিকদের মাধ্যমে পাসপোর্ট দপ্তরের সহকারি পরিচালক মাহামুদুল হাসানের কাছে গেলে, যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। কিন্তু আনসার সদস্যকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে উপস্থিত সাংবাদিকদের ম্যানেজ করার জন্য উঠে পরে লাগে।
একপর্যায়ে সাংবাদিকরা এ বিষয়টি নিয়ে পাসপোর্ট দপ্তরের সহকারি পরিচালকের কাছে তুলে ধরলে তিনি বলেন, আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে তাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানালে উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা তাদেরকে পরিবর্তন করে দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো নতুন যে দল আসে তারাও একই কাজ করে। কিন্তু আপনি আপনার দপ্তর কিভাবে ঘুষ মুক্ত করবেন তাতো আপনার ব্যাপার বললে সহকারি পরিচালক বলেন, আমি বিষয়টি কঠোরভাবে দেখতে পারতাম যদি কেউ একটি লিখিত অভিযোগ দেয়।