বরিশাল গণপূর্তে ৮৫ জনকে ভূয়া নিয়োগের চেষ্টা ॥ কোটি টাকা আত্মসাতের পায়তারা

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২৩:২০, ফেব্রুয়ারি ২৪ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ৮৫ জন ভূয়া কর্মচারীর তালিকা দেখিয়ে বরিশাল গণপূর্তর একটি চক্রের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পায়তারার অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে চক্রটি চাকুরি দেয়ার নাম করে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে। চক্রটির সাথে জড়িত গণপূর্ত বরিশালের সাবেক নির্বাহী ও চার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী তাদের দপ্তরে কর্মরত দেখিয়ে এই ভূয়া তালিকা প্রেরনের মাধ্যমে তাদের বিল-ভাতা উত্তোলনের অপকৌশল গ্রহণ করেছিল। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ ভূয়া তালিকাটি আটকে দিলে মামলা করে তালিকায় নাম থাকা ভূয়া কর্মচারীরা। প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অফিসিয়াল আদেশ জারি হলেও নিশ্চুপ হয়ে আছেন গণপূর্ত বরিশাল বিভাগীয় কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৯ মে গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সংস্থাপন) মোঃ নজিবর রহমান বরিশাল তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর কাছে মাস্টাররোল জনবলের নিয়োজনের আদেশ ও তারিখ চেয়ে একটি চিঠি প্রদান করেন। যার স্মারক নম্বর ৩১৬ (৫০)। তার আদেশ পেয়ে তৎকালিন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে মাস্টাররোলে নিয়োজিত কর্মচারীদের তালিকা চান। ওই সময় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে শুধুমাত্র পিরোজপুরে একজন মাস্টাররোলে নিয়োজিত ছিলেন। অথচ ওই চিঠির প্রেক্ষিতে গণপূর্ত বরিশালে কর্মরত একটি প্রতারক চক্রের সাথে মিলে দপ্তরটির তৎকালীন ইএম উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ আইয়ুব আলী ২৮ জন, মেডিকেল উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী জাহিদুল ইসলাম ১২ জন, গৌরনদী সার্কেলের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাহিদ পারভেজ ২৪ জন ও গণপূর্ত উপ-বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোল্যা রবিউল ইসলাম তার দপ্তরে ২১ জন দৈনিক ভিত্তিক কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছে বলে তালিকা প্রেরণ করেন। যারা ২০১৬ সাল থেকে কর্মরত রয়েছে বলে দাবী করা হয়। যার স্মারক নম্বর ক্রমান্বয়ে ৮৮৭, ২৫৯, ২৯৬ ও ২১২। নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ ওসমান গণী মাস্টাররোলের পরিবর্তে নতুন ৮৫ জন জনবলের এই তালিকা ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দপ্তরে জমা দেন। যার স্মারক নম্বর ৩৪৪৬। নিয়ম বহির্ভুত হওয়ায় তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলৗ কাজী মোহাম্মদ আবু হানিফ কোন রকম ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই ওই জনবলের তালিকা নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। একইসাথে সরকারী নিয়ম বহির্ভূত কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য তাকে সতর্ক করেন। যার স্মারক নম্বর ১৭৯/১(২)। কারন হিসেবে জানা যায়, ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর ও ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্র“য়ারী গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ কবির আহমেদ ভুঞা পৃথক অফিস আদেশ জারি করে বলেন, কার্যভিত্তিক, মাস্টাররোল ও ভাউচার কিংবা অন্যকোন নামে জনবল নিয়োগ করা যাবে না। কেননা ১৯৮৭ সালে গণপূর্ত বিভাগ কার্যভিত্তিক ও মাস্টাররোল আইনে লোক নিয়োগ বন্ধ ঘোষণা করেছে। প্রধান প্রকৌশলী তার আদেশে আরো বলেন, যে কর্মকর্তা এই আইন অমান্য করে জনবল নিয়োগ দেবেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। যথারীতি এই আদেশের কপি বরিশাল নির্বাহী প্রকৌশলীকেও প্রদান করা হয়েছিল। তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে এই ভূয়া জনবলের তালিকা না পাঠানোর কারনে ২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর ওই প্রতারক চক্রটি কর্মচারীদের তালিকার মধ্যে থেকে মোঃ আবু সায়েম, মোঃ মেহেদী হাসান, মোঃ আবুল কাশেম ও মোঃ মাসুম খান নামে চার জনার নাম ব্যবহার করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ৮৫ জনার বেতন ভাতা বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের আবেদন জানান। যার সাথে চার উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর স্বাক্ষরিত ভূয়া জনবলের তালিকাও প্রেরণ করা হয়। সেখানে তারা দাবী করেন, তাদের মতো অনেককেই গণপূর্ত হিসাবের কোড নম্বর ৪৮৫১ উপখাত হতে মজুরি পরিশোধ করা হচ্ছে। তাই সকলের মজুরি নিশ্চিতের আবেদন জানান। তাদের এই আবেদন প্রাপ্তির পর অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নন্দিতা রানী সাহা ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর বরিশাল তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে একটি টিঠি দেন। সেখানে তিনি জানতে চান, কার্যভিত্তিক, মাস্টার রোল ও ভাউচার পদে নিয়োগ বন্ধ থাকা সত্বেও কেন বরিশাল বিভাগের অধিনে ৮৫ জনকে দৈনিক ভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সেই সাথে কোন কর্মকর্তা এই নিয়োগ দিয়েছেন তা জানানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। তবে তৎকালিক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী প্রদীপ কুমার বসু ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারী প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠির জবাবে শুধুমাত্র জানান, ৮৫ জনার তালিকাটি সম্পূর্ণ ভূয়া। যার স্মারক নম্বর ১৮২৬/১(২)। কিন্তু কে বা কারা এই তালিকা তৈরী করেছেন কিংবা কে তাদের নিয়োগ দিয়েছেন এ সংক্রান্ত কোন তথ্য তিনি দেননি। অন্যদিকে এখানেই থেমে থাকেনি ভূয়া কর্মচারীরা। তাদের এ আবেদন ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অগ্রহনযোগ্য হলে তারা ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম মনিরুজ্জামান আসাদের মাধ্যমে একটি আইনী নোটিশ প্রদান করেন। নোটিশ প্রাপ্তির পর গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নন্দিতা রানী সাহা ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারী বরিশালের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে এই মর্মে চিঠি দেন যে উকিল নোটিশের পর কোন মামলা দায়ের করা হয়ে থাকলে সরকারী স্বার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলো। যার স্মারক নম্বর ২৩(৩)। পরবর্তীতে ভূয়া কর্মচারীদের পক্ষে মিনহাজুল ইসলাম অভি নামে একজন আদালতে মামলাও দায়ের করেন। অভি ওই দপ্তরের বরিশাল মেডিকেল উপ-বিভাগের অধিনস্থ শের-ই-বাংলা হাসপাতালে ভাউচার ভিত্তিক কর্মরত লিফট চালক মাহবুব হোসেনের ছেলে। তবে মামলায় ৮৫ জনার পরিবর্তে ৬১ জনার নামের তালিকা প্রদান করা হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন আইনী পদক্ষেপ না নেয়ায় কর্মচারীদের এ দুর্নীতির পিছনে তৎকালিন নির্বাহী ও উপ বিভাগীয় প্রকৌশলীদের জড়িত থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ফলে ঊর্ধতন কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে আর সামনে অগ্রসর হননি। গণপূর্ত বরিশাল অফিসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই ৮৫ জন ব্যাক্তিকে চাকুরি ও বেতন ভাতা পাইয়ে দেয়ার নাম করে জন প্রতি ২ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে গণপূর্ত বরিশাল অফিসের কয়েক কর্মচারী। টাকা নিয়ে প্রতারনার অভিযোগে দপ্তরটির বরিশালে কর্মরত ভাউচার ভিত্তিক কর্মচারী ভিটিএ মাহবুব হোসেনের নামে ওই ৮৫ জনার মধ্যে একজন মামলাও দায়ের করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালে জুলাই মাসে মাহবুব পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। তবে তার সাথে সখ্যতা থাকায় বরিশালের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী জেরাল্ড অলিভার গুডা মাহবুবকে জামিন পাওয়ার পরবর্তী দিনই কাজে যোগদানের অনুমতি দেন। এরপরই এই ভুয়া নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জেরাল্ড অলিভারের সম্পৃক্ততার যোগসূত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দপ্তরটির ওই কর্মকর্তা আরো জানান, ভূয়া কর্মচারীদের তালিকায় গণপূর্ত বরিশালে কর্মরত অনেক স্টাফের ছেলে রয়েছে। মূলত তারাই তাদের সন্তানদের চাকুরি নিশ্চিত করা ও অন্যান্যদের চাকুরির নামে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। দপ্তরে দাখিলকৃত ভূয়া জনবল তালিকা থেকে জানা যায়, মারুফ হোসেন কার্যভিত্তিক পাম্প চালক আব্দুর রব মাঝির ছেলে, আশিকুর রহমান কার্যভিত্তিক পাম্প চালক শাহ আলমের ছেলে, মোঃ শাকিল কার্যভিত্তিক পাম্প চালক জালাল গাজীর ছেলে, মোঃ মেহেদী হাসান হিরণ কার্যভিত্তিক পাম্প চালক শাহাদাত হোসেনের ছেলে। যে কিনা ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতায় হয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। এছাড়া ভূয়া তালিকায় থাকা মোঃ আবু জুবায়ের দপ্তরটির হিসাব সহকারী মোঃ আবুল কালাম আজাদের ছেলে ও মোঃ নাজিউর রহমান গার্ড সিদ্দিকুর রহমানের ছেলে। এই জালিয়াতির সাথে কর্মচারীরা সরাসরি সম্পৃক্ত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা ঢাকায় তাদের তালিকা প্রেরণ না করায় বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী জেরাল্ড অলিভার গুডা ৮৫ জনার তালিকা ভূয়া স্বীকার করে বলেন, এদের কাউকে নিয়োগপত্র দেয়া হয়নি। শুধুমাত্র কর্মস্থল দেখিয়ে তালিকা প্রেরণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় টাকার লেনদেন হয়ে থাকলেও তিনি এই অনিয়মের সাথে জড়িত নন বলে দাবী করেন। কিন্তু কারা জড়িত সেই রিপোর্টও দেয়া হয়নি বলে স্বীকার করেন। তবে আইনী নোটিশ পাওয়ার পর তিনি দাপ্তরিকভাবে এ্যাডভোকেটের মাধ্যমে নোটিশে উল্লেখিত দফাওয়ারী জবাব প্রেরণ করেছেন। পরবর্তী করনীয়র ব্যাপারে কার্যক্রম অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি। এ ব্যাপারে বরিশালের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহমেদ আনোয়ার নজরুল কিছু জানেন না দাবী করে বলেন, বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আর সে বিষয় দায়িত্বপালন করেন নির্বাহী প্রকৌশলী। তবে এই ভূয়া তালিকার ৮৫ জনার জন্য একবার অর্থ বরাদ্দ আসলেও তা দেয়া হয়নি বলে জানান তিনি। বরিশাল জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোঃ নাসিম খান বলেন, ভূয়া তালিকায় গণপূর্ত বরিশাল জোন অফিসেও তিনজন কর্মরত দেখানো হয়েছে। তবে ওই তিনজনসহ বিভাগের কোথাও তারা কর্মরত নেই বলে দাবী করেন। ভূয়া তালিকার বিষয়টি অবগত করে উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।