অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন রিপোর্ট দাখিল

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২৩:০০, ফেব্রুয়ারি ২৪ ২০২১ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন করেছে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যে মন্ত্রনালয়ে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের শৃংখলা- ৩ শাখা হতে প্রাপ্ত স্মারক ৫৬০ এর পত্র অনুযায়ী অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্য’র একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রনালয়। বরিশাল সরকারী কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিরি আহবায়ক, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে সদস্য সচিব এবং একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সদস্য করা হয়। তদন্ত কমিটি কয়েক দফা বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে সরেজমিন পরিদর্শন ও অভিযুক্ত অধ্যক্ষ এবং অভিযোগকারীর সাথে সাক্ষাৎ করে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত কমিটির আহবায়ক। তিনি জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে দাখিল করা হয়েছে। এ ব্যাপারে অভিযোগকারী নাজমুল হক জানান, বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, খামখেয়ালিপনা, পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা, পর্ষদের সভাপতির আদেশ অমান্য করা, ফান্ডে অর্থ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করে দেয়া, শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ উপেক্ষা করে বেতনের অতিরিক্ত বিশ ভাগ টাকা নেয়া, কর্মচারিদের অতিরিক্ত কর্মের টাকা না দেয়া, লাগাতার প্রায় আড়াই মাস কর্মস্থলে না থাকার বিষয়গুলো উল্লেখ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের সচিবের নিকট অভিযোগ দিয়েছি। এছাড়াও কর্মস্থলে না থেকে গাড়ির তেল, ভুয়া বিল ভাউচার এর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়াসহ গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের বিরুদ্ধে। এদিকে অধ্যক্ষ’র বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য প্রমান পেয়ে ভুয়া বিল ভাউচার ফেরৎ পাঠিয়েছেন পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার মোঃ ইয়ামিন চৌধুরী। তার বদলির পর নতুন বিভাগীয় কমিশনার অমিতাভ সরকার সভাপতির দায়িত্ব নেন। তিনিও অধ্যক্ষকে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির কারনে দুটি শোকজ করেছেন। শিক্ষক ও কর্মচারিদের বেতন বন্ধ করে দেয়ার পরে তারা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম তুলে ধরে সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় বেতনের অতিরিক্ত বিশ ভাগ টাকা আটকে দিয়েছিলেন সভাপতি। সূত্রমতে, ২০১৭ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক-২ শাখা থেকে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এর অধ্যক্ষের অতিরিক্ত ভাতা সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ এর ৩২ ধারা অনুযায়ী বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের মুল বেতনের শতকরা ২০ ভাগ বিশেষ ভাতা (অতিরিক্ত ভাতা) প্রদানের সুযোগ নেই। এরপরও বর্তমান অধ্যক্ষ যোগদানের পর থেকেই পরিচালনা পর্ষদের অনুমতি ছাড়া ও শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আদেশ অমান্য করে বেতনের অতিরিক্ত শতকরা বিশ ভাগ বেতন নিয়েছেন, যা সম্পূর্ন অবৈধ। সূত্রে আরো জানা যায়, গত বছর ১১ জুন বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের ৪০ জন স্থায়ী শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বিভাগীয় কমিশনার বরাবরে বেতন অব্যাহত রাখার একটি আবেদন করেন। আবেদনে উল্লেখ করেন অধ্যক্ষ যোগদানের তারিখ থেকে শতকরা বিশ ভাগ পেনশন ভাতা গ্রহন করে আসছেন যা মন্ত্রনালয়ের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বিষয়টি অবহিত হওয়ার পরে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার অধ্যক্ষের মে’ ২০ ও জুন’ ২০ এর বেতন আটকে দিয়ে বেতনের অতিরিক্ত শতকরা বিশ ভাগ বাদ দিয়ে বেতন দাখিল করার নির্দেশ প্রদান করেন। এদিকে অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদার গত বছর ২৫ মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত করোনা মহামারির কারনে বরিশালে না থেকে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন। অথচ এপ্রিল ও মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির গাড়ি ব্যবহারের জ্বালানী ও মেরামতের ভুয়া বিল ভাউচার দাখিল করেন। তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার মোঃ ইয়ামিন চৌধুরী গাড়ি সংক্রান্ত ভুয়া বিল আটকে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে গাড়ির ড্রাইভার মোঃ শাহিন বলেন, ওই সময় করোনার কারনে গাড়ি গ্যারেজে ছিল। আমি গাড়ি ড্রাইভ করি নাই। অধ্যক্ষ স্যার বলেছেন বিল ভাউচার করে দিতে তাই বিল ভাউচার করে দিয়েছি। এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর ২৩৪৯ নং স্মারকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করণের লক্ষ্যে নিয়োগ, পদোন্নতি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর ও অর্থ ব্যয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রসঙ্গের শিরোনামে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বিজ্ঞপ্তিতে ১২ টি মডেল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, পদোন্নতি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ হস্তান্তর (প্রাতিষ্ঠানিক দৈনন্দিন কার্য সম্পাদনের ব্যয় ব্যতিত) এবং নগদ ও ব্যাংকে সংরক্ষিত অর্থ ব্যয়ের উপর নির্দেশক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বে একাধিক শিক্ষককে পদোন্নতি দিয়ে সরকারের লাখ লাখ টাকা শিক্ষকরা আত্মসাত করেছেন। এনিয়ে দেশ জনপদ পত্রিকায় গত বছর একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদার যোগদানের পরেই সিসিটিভি ক্যামেরা ক্রয়, ভবন মেরামত, অধ্যক্ষের বাস ভবন মেরামত, টেবিল চেয়ার মেরামত, ভবনের ছাঁদ মেরামত, পানির লাইন স্থাপনসহ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন শিক্ষা অধিদপ্তের আদেশ নিষেধ অমান্য করে। পরিচালনা পর্ষদকে পাশ কাটিয়ে উন্নয়নের নামে তিনি এসব আর্থিক কর্মকান্ড করেছেন। প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের নামে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিধি না মেনে নিজেই কেনা কাটা করেছেন অর্থ আত্মসাতের জন্য। বর্তমানে অধ্যক্ষের চতুরতা ও খামখেয়ালীপনা, দুর্নীতি আর অনিয়মের কারনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। এছাড়া তিনি শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্য গ্র“পিং সৃষ্টি করছেন নিজের দুর্নীতি অনিয়ম ঢাকতে। এদিকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ক্লাশের নামে আদায়কৃত অর্থ থেকে শতকরা ১৫ ভাগ অর্থ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা ‘১২ এর বিরোধী। নীতিমালার ২ এর (গ) তে উল্লেখ রয়েছে প্রতিষ্ঠানের পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং সহায়ক কর্মচারীদের ব্যয় বাবদ ১০ শতাংশ অর্থ রেখে অবশিষ্ট অর্থ অতিরিক্ত ক্লাসের সাথে নিয়োজিত শিক্ষকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এক্ষেত্রে অধ্যক্ষের নামে কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও অধ্যক্ষ অবৈধভাবে আদায়কৃত অর্থের শতকরা ১৫ ভাগ শিক্ষকদের কাছ থেকে নিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠানটির হিসাবরক্ষন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ তিনি একজন স্বেচ্ছাচারি মনোভাবের মানুষ। তিনি একা একাই সব করেন। কারো আদেশ নিষেধ মানেন না। তিনি বলেন, আমরা হুকুমের গোলাম। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সিনিয়র শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেছেন, অধ্যক্ষের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং যেসব অভিযোগ উঠেছে তার যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এদিকে গত মঙ্গলবার সকল শিক্ষকরা বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের সাথে স্বাক্ষাৎ করে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বিরক্তি প্রকাশ করেন। এ সময় ব্যাপক হৈচৈর সৃষ্টি হয়। শিক্ষকরা বলেন, অধ্যক্ষের খামখেয়ালীপনার কারনে শিক্ষকদের বেতন বরাদ্দের অর্থ ফেরৎ যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। শিক্ষকদের প্রায় এক বছর যাবৎ বেতন বন্ধ অথচ অধ্যক্ষ জানুয়ারী পর্যন্ত অগ্রীম বেতন পাশ করিয়ে রেখেছিলেন যা অবৈধ ও অন্যায়। অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে তদন্ত কমিটিতে থাকা একজন নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের অধিকাংশই সত্য প্রমানিত হয়েছে। অভিযোগকারী ৩৫ ফর্দ কাগজপত্র দিয়েছেন অভিযোগের স্বপক্ষে। এসব কাগজপত্রে প্রমানিত হয়েছে অনিয়মগুলো। এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ সাহিদুর রহমান মজুমদারের বক্তব্য নেয়ার জন্য তার মোবাইলে গত মঙ্গলবার রাত ৮ টা ৫৭ মিনিটে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেন নি। ফলে অধ্যক্ষের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।