হারিয়ে যাচ্ছে বাঁশ ও বেত শিল্পের নান্দনিকতা
নিজস্ব প্রতিবেদ॥ আধুনিক সভ্যতার প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে বরগুনার বেতাগী উপজেলা ও পৌর শহরের বাসিন্দারা হারাতে বসেছে বাঁশ ও বেত শিল্পের নান্দনিক ব্যবহার। বাঁশ আর বেতের তৈরি বিভিন্ন পন্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে আঁকড়ে রেখেছে উপজেলার কিছু সংখ্যক পরিবার।
বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বেতাগী উপজেলায় বাঁশ ও বেত শিল্পের তৈরি মনমুগ্ধ বিভিন্ন জিনিসের জায়গা করে নিয়েছে স্বল্প দামের প্লাষ্টিক ও লোহার তৈরি পন্য। তাই বাঁশ ও বেতের তৈরি মনমুগ্ধকর সেইসব পন্য এখন হারিয়ে যাওয়ার পথে।
কদর না থাকায় গ্রামগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাঁশের তৈরী বিভিন্ন নিত্য প্রয়োজনীয় আকর্ষনীয় আসবাবপত্র। অভাবের তাড়নায় এই শিল্পের কারিগররা দীর্ঘদিনের বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ অনেকে অন্য পেশার দিকে ছুটছে। শত অভাব অনটনের মাঝেও উপজেলায় হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও পৈতৃক এই পেশাটি ধরে রেখেছেন।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে বেতাগী পৌরসভা ও উপজেলার ৭ টি ইউনিয়নের ৪৬ টি পরিবারই বর্তমানে এই শিল্পটি ধরে রেখেছেন। যেখানে একযুগ আগেও এ উপজেলায় চার শতাধিক পরিবার এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বাঁশ দিয়ে এই সব পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বাঁশ ও বেত দ্বারা এই সব পণ্য তৈরি করে থাকেন। বর্তমানে বেত তেমন সহজ লভ্য না হওয়ায় বাঁশ দিয়েই বেশি এই সব চিরচেনা পণ্য তৈরি করছেন এই কারিগররা। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আজ অনেক পরিবারই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। বর্তমানে আধুনিতার যুগে বাজারে সহজলভ্য ও আর্কষনীয় বিভিন্ন প্লাষ্টিক পণ্য ও আন্যান্য দ্রব্য মূল্যের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় এই শিল্পের অনেক কারিগররা তাদের বাপ-দাদার পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব বাঁশ শিল্পের কারিগররা তাদের পূর্ব পুরুষের এ পেশা আকঁড়ে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও হিমশিম খাচ্ছেন। দিন দিন বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্য যে ভাবে বাড়ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে না এই শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। যার কারণে কারিগররা জীবন সংসারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।
কয়েক দশক আগে বেতাগী পৌর শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালানো হতো এই কারিগরদের তৈরি এই সব বাঁশ ও বেতের পণ্যগুলো। এক সময় বেতাগী উপজেলাসহ দেশের ঘরে ঘরে ছিল বাঁশের তৈরী এই সব সামগ্রীর কদর ছিল অনেক। কালের আর্বতনের সাথে সাথে বিশেষ আর চোখে পড়ে না এই পণ্যগুলো। অপ্রতুল ব্যবহার আর বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাঁশ শিল্প আজ হুমকির মুখে। বাঁশ ও বেত থেকে তৈরী সামগ্রী শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, ঝাড়ু, টোপা, ডালী। বাড়ির নারী ও পুরুষরা সাজি, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপি, ফুলদানি, ফুলের ডালি, খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, সোফা সেট, খাট, মাছ ধরার পোলোসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র নান্দনিক ব্যবহার ছিলো।
এক সময় যে বাঁশ ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেত সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে দুইশত থেকে আড়াইশ টাকা সেই সাথে বাড়েনি এসব পণ্যের দাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর বাড়ী নির্মাণে যে পরিমান বাঁশের প্রয়োজন সে পরিমান বাঁশের ঝাঁড় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এরফলে বর্তমানে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত পরিবারগুলো আগ্রহ হারাচ্ছে।
উপজেলার বাসন্ডা গ্রামের অনেকে বলেন, হাতে গোনা আমরা কয়েকটি পরিবার আজও এ কাজে নিয়োজিত আছি। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সকল খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ১০-২০টাকা করে লাভ থাকে। তবে বর্তমানে আগের মত আর বেশি লাভ হয় না। তারা নিজেরাই বিভিন্ন হাটে গিয়ে ও গ্রামে গ্রামে ফেরি করে এই সব পণ্য বিক্রয় করে থাকেন।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক প্রশিক্ষক মোসা. নাসিমা বেগম বলেন,’ বাঁশ ও বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার। ‘
হোসনাবাদ গ্রামের রতন হাওলাদার জানান, অতি কষ্টে তাদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ শিল্প টিকে রাখতে ধার দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে বেশি লাভ দিয়ে টাকা নিয়ে কোন রকম বাপ-দাদার এই পেশাকে আকঁড়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি।’
পুটিয়াখালী গ্রামের রমেশ চন্দ্র মন্ডল জানান,’ আমাদের এই পেশার উন্নতি কল্পে যদি সরকারি ভাবে অল্প লাভে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে বাঁশ ও বেত শিল্পের কারিগররা স্বাবলম্বী হবে। এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। ‘
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন মজুমদার বলেন,’ বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে কৃষকদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া প্রয়োজন।’
এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন,’ বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার। কৃষক ও কারিকরদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং যথাযথ প্রশিক্ষনে অংশগ্রহণ করানো দরকার।’