ফেরির অব্যবস্থাপনায় দক্ষিণাঞ্চলের সড়কে দুর্ভোগ

কামরুন নাহার | ২২:৫৬, জানুয়ারি ২০ ২০২০ মিনিট

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ॥ ফেরির অব্যবস্থাপনা ও দুর্বল অবকাঠামো এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নির্বিঘœ হচ্ছে না দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টেকসই ফেরির অভাবের সাথে অত্যাধীক মালামাল বোঝাই যানবাহন ফেরি সার্ভিসকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে বারবার। এরই সাথে প্রয়োজনীয় সচল ফেরির অভাবে ফেরি ঘাটগুলোতে দুরপাল্লার যাত্রীদের দূর্ভোগও এখন বর্ণনার বাইরে। ফলে নদ-নদী নির্ভর দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় সীমাহীন দূর্ভোগ জনগনের পিছু ছাড়ছে না। যদিও গত দুই দশকে ঢাকাÑফরিদপুরÑবরিশালÑপটুয়াখালীÑকুয়াকাটা এবং বরিশালÑপিরোজপুরÑখুলনা মহাসড়কের ১০টি ফেরি পয়েন্টে ছোটÑবড় সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু এর পরেও ঐসব মহাসড়ক ছাড়াও বরিশালÑভোলা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নদ-নদীগুলো পারাপারে ফেরি সার্ভিস যথেষ্ট বিড়ম্বনায় রেখেছে এ অঞ্চলের মানুষকে। চট্টগ্রাম থেকে লক্ষ্মীপুরÑভোলাÑবরিশাল হয়ে মোংলা ও খুলনা মহাসড়ক চালু হলেও টেকসই ফেরি ব্যবস্থাপনার অভাবে পণ্য পরিবহনে সময় ও ব্যয় বাড়ছে। সারা দেশের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলার সড়ক-মহাসড়কে যেমনি ফেরি আধিক্য বেশী, তেমনি এ সেক্টরে দূর্ঘটনার সাথে বিড়ম্বনাও অনেক। মাত্রারিক্ত ভার বহনের পাশাপাশি ত্র“টিপূর্ণ যানবাহনের সাথে দীর্ঘদিনের পুরনো ফেরির কারনে একের পর এক দূর্ঘটনাও ঘটছে। গত শনিবার বরিশালÑবাবুগঞ্জ-মুলাদী-হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ সড়কের মীরগঞ্জ পয়েন্টে ধারন ক্ষমতার দ্বিগুন বিদ্যুৎ খুটি নিয়ে পার হবার সময় ফেরির গ্যাংওয়ের উপরে ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে পেছনে ছিটকে পড়ে পন্টুনসহ ট্রাকের অর্ধেক নদীতে নিমজ্জিত হয়। ফলে টানা ১২ ঘন্টারও বেশী সময় ঐ রুটে যানাবাহন পারপার বন্ধ থাকে। বরিশাল সড়ক বিভাগ ও ফেরি বিভাগের প্রকৌশলীগন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিকল্প পন্টুন ও গ্যাংওয়েয় চালু করে যানবাহন পারাপার শুরু করেন রবিবার সকাল থেকে। গত বছর রাতের আঁধারে চট্টগ্রামÑলক্ষ্মীপুরÑভোলাÑবরিশালÑমোংলাÑখুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়া পয়েন্টে কঁচা নদীতে কয়েকটি বাস-ট্রাক নিয়ে পারপারের সময় জ¦ালানীবাহী নৌযানের সাথে সংঘর্ষে সড়ক বিভাগের একটি ফেরির তলা ফেটে যায়। চালক দ্রুত নিকটবর্তি একটি চরে ফেরিটি তুলে দিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়াতে সক্ষম হলেও ডুবো চরে নৌযানটি ডুবে যায়। ঐ দূর্ঘটনায় প্রানহানী না ঘটলেও বাস-ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনসহ ফেরিটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। দক্ষিণাঞ্চলে সড়ক বিভাগের বেশীরভাগ ফেরিতেই রাতের বেলা চলাচলের মত প্রয়োজনীয় সংকেত বাতি সহ সার্চ লাইট থাকেনা বলে অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং বিআইডব্লিউটিসি দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সংযোগ সড়কের ১৮টি পয়েন্টে ফেরি সার্ভিস পরিচালন করে আসলেও এর বেশীরভাগেই দীর্ঘদিনের পুরনো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ফেরি চলছে সম্পূর্ণ জোড়াতালি দিয়ে। সড়ক অধিদপ্তরের ১৭টি পয়েন্টে যে ২৬টি ফেরি পরিচালন করছে তার মধ্যে মাত্র ২টি নতুন। অবশিষ্টগুলো পাঁচ বছর থেকে ২০ বছরের পুরনো। অনেক ফেরিতে দুই যুগেরও বেশী পুরনো ইঞ্জিন চলছে না চলার মত করে । দক্ষিণাঞ্চলে বিআইডব্লিইটিসি ভোলা ও বরিশালের মধ্যবর্তি লাহারহাটÑভেদুরিয়া সেক্টরে ৪টি ইউটিলিটি ফেরি পরিচালন করলেও তার দুটি এক দশকেরও বেশী পুরনো। ঐ সেক্টরে সংস্থাটির ৪টি ফেরির মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরে একটি ফেরি বিকল অবস্থায় মেরামতের অপক্ষোয় রয়েছে। অপরদিকে ভোলা ও লক্ষ্মীপুরের মধ্যবর্তি ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উপমহাদেশেরর সর্বাধিক দুরত্বের ফেরি সেক্টরটিতে মাত্র ৩টি ফেরি চলাচল করায় যানবাহন পারাপারে ১০-১২ ঘন্টার বেশী সময় ঘাটেই অপেক্ষমান থাকতে হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর তার বরিশাল ও পটুয়াখালী ফেরি বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যেসব ফেরি সার্ভিস চালু রেখেছে তারমধ্যে বরিশালÑপটুয়াখালী মহাসড়কের লেবুখালী এবং বরিশালÑখুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়াতে মাত্র দুটি ফেরি নতুন। অন্য ২৫টি ফেরিই পুরনো। ‘ইউটিলিটি-১’ ও ‘ইউটিলিটি-১ উন্নত’ মডেলের এসব ফেরির বেশীরভাগই চলছে জোড়াতালি দিয়ে। বেশীরভাগ ফেরির ইঞ্জিনগুলো এতই পুরনো যে তা এখন মেরামত করেও পরিচালন সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দায়িত্বশীল মহল। এমনকি এসব ফেরির হাল, খোল ও উপরি কাঠামোর অবস্থাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলছে এসব ফেরি। বর্ষার সময় পায়রা, কঁচা ও বলেশ^র-এর মত বড়-বড় নদী পাড়ি দিতে অনেক সময়ই ফেরির ইঞ্জিন মাঝ নদীতে বন্ধ হয়ে যাবার মত অঘটনও ঘটছে। ফলে খরগ্রোতা নদ-নদীর প্রবল গ্রোতে অনেক সময়ই বিপুল সংখ্যক যাত্রী ও যানবাহন সহ ফেরিগুলো ভেসে গিয়ে ভয়াবহ ঝুকি সৃষ্টি করছে। আবার শীতের প্রচন্ড কুয়াশায় এসব ফেরি চলাচলের মত টেকসই সার্চ লাইট সহ প্রয়োজনীয় নৌ-সংকেত সরঞ্জামেরও অভাব রয়েছে। অথচ এসব ফেরি অনেক গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ অতিক্রম করেই প্রতিদিন সহগ্রাধীক যানবাহন পারাপার করছে। অথচ সড়ক অধিদপ্তরের কোন ফেরি নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের নিবন্ধিত নয়। ফলে তাতে নৌ সহায়ক সরঞ্জামাদি থাকা না থাকার দায়ও নেই কারো। অপরদিকে সরকারী নীতিমালার আলোকে দক্ষিণাঞ্চলের সবগুলো ফেরি ও ফেরিঘাটগুলোই ইজারার মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় যানবাহন পারাপারে ইজারাদারের খামখেয়ালীপনার কাছেই জিম্মি এ অঞ্চলের যাত্রী সহ যানবাহনের চালক ও মালিকগন। বরিশালÑখুলনা মহাসড়কের বেকুঠিয়াতে প্রতি ঘন্টায় মাত্র একবার ফেরি পারাপার হবার পুরেনা অলিখিত নিয়মও এখন ইজারাদার অনুসরন করছে না। ফলে ঐ ফেরি পয়েন্টের দু-প্রান্তেই প্রতিনিয়ত অপেক্ষমান যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে। চরম দূর্ভোগে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের মানুষ। বরিশাল-পটুয়াখালীÑকুয়াকাটা মহাসড়কের লেবুখালীতে পায়রা নদীতে চলাচলকারী ৪টি ফেরির মধ্যে ৩টি সচল থাকলেও সেখানেও যানবাহন পারাপারে চরম দূর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে। এ দুটি ফেরি পয়েন্টেই পর্যায়ক্রমে ১টির বেশী ফেরি কখনোই যানবাহন পারাপার করে না। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে সড়ক অধিদপ্তরের অন্য ১৫টি ফেরি পয়েন্টে মাত্র ১টি করে ফেরি থাকায় সেসব স্থানে যথেষ্ঠ ঝুকি নিয়েই যানবাহন পারাপার হচ্ছে। কারন দীর্ঘদিনের পুরনো ঐসব ফেরি প্রায়সই বিকল হয়ে সড়ক যোগাযোগই বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। এসব ব্যাপারে বরিশাল সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সুশীল কুমার সাহার সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, দক্ষিণাঞ্চলে নতুন ও ভাল মানের ফেরির চাহিদা আমরা সদর দপ্তরকে জানিয়েছি। সড়ক অধিদপ্তরও চেষ্টা করছে। ফেরি চলাচলে সব সময় নিয়মকানুন অনুসরনে বারবারই তাগিদ দেয়ার কথাও জানা তিনি। পাশাপাশি মাত্রাতিরক্ত বোঝাই ট্রাক পারাপার না করতেও বলা হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে একাধিক যানবাহনের মালিক ও চালকের মতে, ‘দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনের অর্ধেক সময় ফেরিঘাটে কাটলেও’ দীর্ঘ দিনেও তা থেকে পরিত্রান মেলেনি। এমনকি একারনে এ অঞ্চলে পরিবহন ব্যবসায় নতুন কোন বিনিয়োগও আসছেনা বলেও তারা অভিযোগ করেন।