থামছেনা হত্যাযজ্ঞ

দেশ জনপদ ডেস্ক | ২২:০৮, নভেম্বর ১৮ ২০২০ মিনিট

মির্জা রিমন ॥ ঢাকা-বরিশাল নৌপথের বিলাসবহুল লঞ্চযাত্রায় থামছেনা হত্যাযজ্ঞ। বছরজুড়ে প্রায় প্রতিটি লঞ্চেই ঘটছে হত্যাকান্ড। গত পাঁচ বছরে কমপক্ষে ১০/১২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে সুন্দরবন, পারাবত, সুরভী, কীর্তনখোলা ও এ্যাডভেঞ্চারসহ বৃহত্তর লঞ্চগুলোতে। চলতি বছরের গত ১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোরে সুন্দরবন-১১ লঞ্চের ছাদে শামীম তালুকদার (২৫) নামে এক যাত্রী খুন হন। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর এমভি পারাবত-১১ নামক লঞ্চের স্টাফ কেবিন থেকে এক নারী যাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দেশের বিলাসবহুল ও বৃহত্তর নৌযানগুলোতে অস্ত্রধারী আনসার সদস্যরা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত না থাকায় থামছে না একের পর এক হত্যাকান্ড। যদিও সরকার থেকে প্রত্যেক লঞ্চে ৬/৮ জন করে সশস্ত্র আনসার সদস্য নিয়োগ করার কথা থাকলেও মালিকরা এর বিপরীতে দুই থেকে তিনজন সিকিউরিটি গার্ডের জন্য নিজস্ব স্টাফ রাখছেন। জাতীয় বেতনের স্কেল অনুসারে একজন আনসার সদস্যকে ১৬/২০ হাজার টাকা বেতন দিতে হবে। এতে করে ৬/৮ জন সশস্ত্র আনসার সদস্য’র জন্য প্রতিমাসে প্রায় দেড় লক্ষাধিক টাকা বেতন দিতে হবে বিধায় লঞ্চে আনসার সদস্য নিয়োগ দিচ্ছে না মালিকপক্ষ। কিন্তু এর বিপরীতে একজন সশস্ত্র আনসার সদস্য’র বেতনের টাকা দিয়ে তিন থেকে চারজন সিকিউরটি কোম্পানির গার্ডদেরকে নিরাপত্তা কর্মী হিসেবে রাখছেন। শুধু তাই নয়, সিকিউরটি কোম্পানির গার্ডদেরকে আনসারের পোশাক পড়িয়ে ডিউটি করায় যা পুরোটাই অবৈধ। লঞ্চ মালিকপক্ষের এমন কুটকৌশলের কারণে ঢাকা-বরিশাল বিলাসবহুল এ নৌপথটি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে জানতে লঞ্চ মালিক সমিতির আহ্বায়ক এসপি মাহবুব বলেন, ১৯৮০ সালে প্রথম বাংলাদেশে লঞ্চে আনসার সদস্য নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়। কিন্তু সাম্প্রতি ৫/৭ বছর ধরে আনসার সদস্যদের লঞ্চে নেয়া হয়না। কারণ আনসার সদস্যরা তাদের রুমগুলোতে যাত্রী ভাড়া দেয়। এছাড়া তাদের অস্ত্রও লুট হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। যে কারণে আনসার সদস্য নেয়ার জন্য আমরা নিরুৎসাহী। কিন্তু ঢাকা-বরিশাল নৌপথে ৭/৮ ঘন্টার রাত্রীকালীন যাত্রায় তো দৈণিক প্রায় লক্ষাধিক যাত্রী নিরাপত্তাহীনতায় থাকে, সেক্ষেত্রে লঞ্চে আনসার সদস্য থাকা কি জরুরী নয় জানতে চাইলে লঞ্চ মালিক সমিতির আহ্বায়ক আরো বলেন, নৌপথের নিরাপত্তার জন্য নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড রয়েছে। তারা যাত্রীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। তবে এ বিষয়ে ভিন্নমত জানালেন বরিশাল আনাসার ভিডিপির জেলা কম্যান্ড্যান্ট মো: আম্মার। তিনি বলেন, লঞ্চ যখন ছাড়পত্র পায় তখনই লঞ্চমালিকদের ম্যানুয়ালে লেখা থাকে আনসার বাহিনী কর্তৃক নিরাপত্তার কথা। আর আনসার বাহিনীর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা দেয়ার আন্তুরিকতা রয়েছে অথচ লঞ্চ মালিকরা তা নিচ্ছেনা। কিন্তু লঞ্চ ঘাট থেকে ছাড়ার মুহুর্তে লঞ্চে ঘোষনা দেয়া হয় যে, লঞ্চের নিরাপত্তায় আনসার বাহিনী রয়েছে অথচ লঞ্চে আনাসার নেই। কিন্তু তারা লঞ্চে কোম্পানির সিকিউরিটি ব্যবসায়ীদের থেকে গার্ড নিয়ে নিরাপত্তার কাজ করায়। উক্ত গার্ড সদস্যরা আমাদের আনসার বাহিনীর পোশাক পরিধান করে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ব্যাপারে আমরা একাধিকবার মোবাইল কোর্টও পরিচালনা করেছি। লঞ্চে আনসার সদস্য দেয়ার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, প্রতি দুমাস পরপর জেলা প্রশাসক দপ্তরে মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় আমরা বিষয়টি তুলে ধরি এবং লঞ্চের নিরাপত্তার জন্য আনসার বাহিনী নিয়োগ দেয়ার জন্য বলি। এছাড়া বিষয়টি যাত্রীদের নিরাপত্তার সাথেও চরমভাবে জড়িত। লঞ্চে আনসার না নেয়ার বিষয়টি আমাদের হেডকোয়ার্টারেও জানিয়েছি। এদিকে, যাত্রী কল্যান সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রীদের যাতায়াতে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া একটি মৌলিক অধিকার। নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি যাত্রীদের যাতায়াতে নিরাপত্তার বিষয়টি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আরো গুরুত্বের সাথে দেখবে বলে আশা করছি এবং প্রয়োজনে লঞ্চগুলোতে আনসার সদস্যদের পুনুরায় নিয়োগ দিবে। ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বিলাসবহুল লঞ্চযাত্রাকে আরো সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে কি করণীয় রয়েছে জানতে চাইলে বরিশাল আধুনিক নৌবন্দর কর্মকর্তা মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৯৭০ সালের নৌ পরিবহন আইনে লঞ্চে আনসার বাহিনী নিতে হবে তা উল্লেখ নেই। তবে যাত্রী পরিবহনে নিরাপত্তায় ট্রাফিক সংশ্লিষ্ট যেমন বয়া, দক্ষ জনবলসহ এগুলোর প্রস্তুতির বিষয়ে উক্ত আইনে উল্লেখ আছে। এছাড়া যদি আনসার বাহিনী তাদের কোন পরিপত্রে লঞ্চে আনসার বাহিনী নিয়োগ দিতে হবে এ মর্মে যদি কোন নির্দেশনা দেয় তাহলে আমি সকল লঞ্চ মালিকদের চিঠি দিয়ে আনসার সদস্য নিতে বলতে পারবো। আর যদি কোন লঞ্চ মালিক তা অমান্য করে তাহলে তার রুটপারমিট বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। তিনি আরো বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা তো বাধ্যতামূলক এবং তা লঞ্চ মালিকদের দিতেই হবে। আর পাশাপাশি যাত্রী সাধারণেরও সচেতন হতে হবে। দেশ এখন ডিজিটাল হয়েছে এছাড়া লঞ্চে সিসি ক্যামেরাও রয়েছে। আর সিসি ক্যামেরার ফূটেজ দেখে লঞ্চের অধিকাংশ হত্যাকান্ড উদঘাটন হয়েছে। এছাড়া ঢাকা-বরিশাল নৌপথের যাত্রায় একের পর এক খুনের ঘটনা প্রতিরোধে আনসার সদস্যদের ডিউটি লঞ্চগুলোতে অত্যাবশ্যক হওয়ার পাশাপাশি নৌপুলিশের আর কি করণীয় রয়েছে জানতে চাইলে নৌ পুলিশের এসপি (ক্রাইম) ড.আ.ক.ম.আকতারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, অবশ্যই লঞ্চগুলোতে আনসার সদস্যরা যদি পালাক্রমে সশস্ত্র ডিউটি করে তাহলে অধিকতরভাবে এধরণের অপরাধ কমে যাবে। আর পাশাপাশি আমাদের নৌপুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থাপনাতো থাকছেই। অপরদিকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, এবিষয়টি অবশ্যই মানবিক। কারণ একেকটি লঞ্চ প্রায় দেড় সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে পুরো রাত অবধি নদীপথে ভাসতে থাকে। পথিমধ্যে কিছু ঘটলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দেয়া ও ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার করা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর এসময়ের মধ্যে লঞ্চে অনেক কিছু ঘটতে পারে। যেকারণে লঞ্চেই যদি অস্ত্রধারী নিরাপত্তা রক্ষী থাকে তাহলে তারাই লঞ্চ বিপদগ্রস্থ হওয়ার শুরুতেই সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে। তিনি আরো বলেন, অবশ্যই আমি কালকেই নৌমন্ত্রী মহোদয়ের সাথে বিষয়টি তুলে ধরবো। সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-বরিশাল নৌপথে শুধুমাত্র বরিশাল বন্দর থেকে দৈণিক ৫/৭টি বিলাসবহুল লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করে। এছাড়া পিরোজপুর, ঝালকাঠী, বরগুনা থেকেও দৈনিক ২/৩টি লঞ্চ ছেড়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। প্রতিটি লঞ্চে প্রতিদিন প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার যাত্রী পরিবহন করে। বিভিন্ন সরকারি ছুটি ঈদ মৌসুমে যাত্রী সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যায়। বরিশাল ও ঢাকা নৌবন্দর থেকে লঞ্চগুলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বন্দর ত্যাগ করে রাত নয়টায় এবং শেষ রাতে এসে যাত্রী যাত্রা শেষ করা হয়। ৭/৮ ঘন্টার এ নৌযাত্রায় ২/৩হাজার যাত্রীর নিরাপত্তায় নৌযানগুলোতে কোন প্রকার অস্ত্রধারী নিরাপত্তা বাহিনী থাকেনা। প্রতিদিন এ নৌযানগুলোকে প্রায় ২/৩’শ কিলোমিটার নৌপথে কোনপ্রকার নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই চলতে হয়।