ভোলার ২৭২ বছরের ঐতিহ্য হায়দার আলী জমিদার বাড়ি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ভোলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন হায়দার আলী জমিদার বাড়ি। ২৭২ বছরের প্রাচীন এই বাড়িটি নির্মাণ করেন জমিদার হায়দার আলী। তার নামানুসারে জমিদার বাড়ির নামকরণ হায়দার মহল। ১৫ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত তিন তলা বিশিষ্ট এই বাড়ি এখনো জমিদারী ইতিহাসের স্বাক্ষ্য বহন করে আছে। বাংলা ১১৫৫ সালে জমিদার হায়দার আলী তার জমিদারী শুরু করেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত জমিদারী ধরে রাখেন। বাড়ির আশপাশে একটি বড় দীঘি ও বাগান রয়েছে। তৎকালীন কালীগঞ্জ নামে বর্তমানে বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নে বাড়িটি অবস্থিত। রিয়াজ উদ্দিন আকনের ছেলে হায়দার আলীর ছয় ছেলের মধ্যে দুই ছেলে জমিদারী করে গেছেন। ইতিহাস বলছে, হায়দার আলীর ছেলেদের মধ্যে ইয়াকুব আলীর বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে খেলাফত ও কংগ্রেস কর্মী হিসেবে বড় ধরনের ভূমিকা ছিলো। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানে স্কুল-মসজিদসহ একাধিক স্থাপনা নির্মাণ করেন। হায়দার আলীর বংশধর মাইনুল আহসান জুনায়েদ বলেন, জমিদার হায়দার আলীর চার হাজার একর সম্পত্তি ছিলো। তার ছয় ছেলের নাম আসমত আলী মিয়া, হেদায়েত আলী, এহসান আলী, এমদাত আলী, ইয়াকুব আলী ও লুতফে আলী। হায়দার আলী ৪২ বছর বয়সে মারা যান। তিনি প্রায় ২০ বছর জমিদারী পেশা ধরে রেখে ছিলেন। তার পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে এমদাদ আলী ও লুতফে আলী জমিদারী ধরে রাখেন। এমদাত আলী ৭৪ বছর বয়সে এবং লুতফে আলী ৬০ বছর বয়সে মারা যান। বর্তমানে এই বাড়িটি এমদাত আলী ও আসমত আলীর নাতিদের দায়িত্বে থাকলেও সেখানে কেউ বসবাস করেন না। ১১৫৫ বঙ্গাব্দে হায়দার মহলের মূল ভবন নির্মাণ শেষ হয়। এই হায়দার মহলের মূল ভবন ছাড়াও পেছনের দিকে একতলা আরো চারটি ভবন রয়েছে। এ ভবনগুলো তৈরিতে বালু ও সিমেন্টের পরিবর্তে ব্যয়বহুল চুনা ও সুরকি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতিটি দেয়াল দেড় হাত পুরু। বিল্ডিং নির্মাণের সময় ভিম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে উন্নত মানের শাল কাঠ- যা তিন-চারশ বছর পর এখনো অক্ষত। বাড়িটির আয়তন সর্বমোট ১১৪ একর ২২ শতাংশ। সংস্কারের অভাবে বর্তমানে বাড়িটি জরাজীর্ণ হলেও এখনো দৃষ্টিনন্দন। এই বাড়িতে একটি বিশাল আকৃতির দীঘি রয়েছে। সেসময় এ বাড়ির জমিদাররা শখ করে হরিণ, ময়ূরসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় প্রাণী পুষতেন। কালের সাক্ষী হিসেবে আজো ওই হায়দার মহলে বিশাল আকৃতির হরিণের শিং, ময়ূরের পালক, বাঘের চমড়াসহ নানা রকম ঐতিহ্য সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও কিছু কিছু ঐতিহ্য জাতীয় জাদুঘরে শোভা পেয়েছে। তৃতীয় তলায় দেখা যায়, কয়েকশ বছরের প্রাচীন এ ভবনের প্রতিটি দেয়াল পুরনো কিন্তু আজো অক্ষত। শুধু কয়েক স্থানে শ্যাওলা জমে আগাছার সৃষ্টি হয়েছে। হায়দার মহলের সামনের দিকে দক্ষিণ পাশে রয়েছে ফুলের বাগান, দরজায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ, সুপ্রাচীন প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাইক্লোন শেল্টার, ঈদগাহ মাঠসহ বাড়ির ভেতরে অসংখ্য গাছ-গাছালি। এদিকে বাড়িটির ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, ভোলা দ্বীপের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে এসে বসতি গড়ে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় কুমিল্লার জনৈক ইজ্জত উল্লাহ আকন ভোলার স্থানীয় খায়রুল্লাহ বিশ্বাসের মেয়েকে বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তার একমাত্র ছেলে রিয়াজ উদ্দিন আকন তৎকালীন জমিদার তারা প্রসন্ন ভট্টাচার্যের জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব পান। একসময় তিনি প্রচুর জমি ও অর্থ সম্পদের মালিক হন। তিনি ‘জমিদার’ হিসেবে খ্যাতি পান। তার ছেলেই হায়দার আলী। যার নামে ‘হায়দার মহল’। এদিকে এই হায়দার মহলে ৩০ বছর ধরে কেউ থাকে না। তাই সংরক্ষণের অভাবে অযতেœ-অবহেলায় পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন। তারপরেও প্রচীনতম দৃষ্টিনন্দন এই বাড়িটি দেখতে ছুটে আসেন অনেক দর্শনার্থী। প্রচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার দাবি স্থানীয়দের।