রিপোর্ট দেশ জনপদ ॥ করোনা মহামারিতে দেশের নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশের কোনো উপার্জন নেই। আয় কমে গেছে ৬৭ ভাগ উদ্যোক্তার আর অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মজীবীদের আয় কমেছে ৬৬ ভাগ। সরকার ঘোষিত ছুটি ও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত আরোপের ফলে গত ফেব্রুয়ারি থেকে গত জুন পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজের সুযোগ হারানোদের মধ্যে ৫৮ শতাংশই নারী। ফলে ৯০ ভাগ নারী উদ্যোক্তা এবং ৮৪ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী নারী সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়েছেন। কভিড-১৯ মহামারীতে কুটির, অতি ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির-শিল্প উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী নারীদের অবস্থা’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের উদ্যোগে সমীক্ষা পরিচলনা করে অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ প্রোগ্রাম। গত ৮ থেকে ২৪ জুলাই দেশের ২৮ জেলার ১৭৪টি উপজেলায় পরিচালিত এই জরিপে মোট ১ হাজার ৫৮৯ জন নারী অংশ নেন, যার মধ্যে ৫৮৯ জন উদ্যোক্তা এবং এক হাজার জন কর্মী। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৩২ ভাগ হলেন গ্রামীণ নারী, বাকি ৬৮ ভাগ শহরাঞ্চলের।
সমীক্ষায় দেখা যায়, এই দুর্যোগকালে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্যোক্তার সংখ্যা ৩৩ ভাগ। এ ছাড়া ৪১ ভাগ উদ্যোক্তা কর্মীদের কর্মবিরতিতে (লে অফ) পাঠিয়েছেন। ব্যবসায়িক সংকটগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাঁরা কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেননি আর ৮৬ শতাংশ উদ্যোক্তা। আর টিকে থাকার জন্য আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে তাঁদের ঋণ নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ৩৯ শতাংশ কর্মজীবী নারী। তবে এতসব সমস্যার পরেও এই নারী উদ্যোক্তা ও কর্মজীবীরা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে এজন্য আর্থিক সহায়তা চান ৮৩ শতাংশ কর্মজীবী নারী। আর সহজ শর্তে ও অল্প সুদে ঋণ চান ৭৯ শতাংশ উদ্যোক্তা। পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণও চান তারা। কাজ ও ব্যবসা উদ্যোগ ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন এক শতাংশ। ব্যবসায় উদ্যোগগুলোর জন্য সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এই উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ সরকারি এই প্রণোদনার খবর জানতেন বলে সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়। বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই তাদের ব্যবসায়ের জন্য এনজিওগুলোর ঋণ সহায়তাকেই বেছে নিয়েছেন।
সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার আয়োজিত ‘কাজে ও ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত নারী’ শীর্ষক এক অনলাইন সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুস সালাম বলেন, ‘সরকারের পরিকল্পনা গ্রহণেও কৌশলগত পরিবর্তন আসছে। কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশাল প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কর্মসংস্থান ব্যাংকসহ আরো কিছু ব্যাংক ঋণদান করছে।’ এ সময় ডিসেম্বরের মধ্যেই এই অভাবের চিত্রটা পালটে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘কুটিরশিল্প ও অতি ক্ষুদ্র ব্যবসা উদ্যোক্তা এবং কর্মীদের এই গবেষণায় আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে- এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সামগ্রিকভাবে খানাজরিপ করা হলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের তালিকাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকৃত চিত্র পাওয়া যেত। এখন প্রয়োজনে এনজিওর মাধ্যমে এদের প্রণোদনা বিতরণ করার উদ্যোগ নিলে এ সমস্যা মোকাবেলা সহজ হবে।’
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘আমরা যদি গত চার পাঁচমাসে দেখা দেওয়া সঙ্কটগুলো কাটিয়ে উঠার সংকল্প নিই, যেমন- যথাসময়ে যথাস্থানে সহায়তা পৌঁছানো, নারীর প্রতি সহিংসতা ও স্কুলশিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা গেলে আমরা অবশ্যই অবস্থার উন্নতি করব। নারীর মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন এই সংকটে আরো প্রান্তিক না হয়ে পড়েন, সেই লক্ষ্যে আমাদের সরকার, সামাজিক সংগঠন ও এনজিওদের একত্রে কাজ করতে হবে।ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক শামেরান আবেদ বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা নারীরা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে সাধারণত ঋণ পান না। আর কুটির ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তো ব্যাংকে যেতেই পারেন না। এনজিওগুলোকে এ দিকে নজর দিতে হবে, কিন্তু তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। সরকারি-বেসরকারি উভয়দিকেই সমন্বিত উদ্যোগে এর সমাধান খুঁজতে হবে।ইউসেপ বাংলাদেশ’র চেয়ারপারসন পারভিন মাহমুদ বলেন, ‘নিউ নরমালে টিকে যাওয়ার জন্যে নারীদের ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় বদল আনার জন্যে সক্ষমতা এবং দক্ষতার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আমাদের সরকারের পলিসিতে থাকলেও মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সের সুযোগ নাই আমাদের দেশে। আমি মনে করি, কটেজ এবং মাইক্রো শিল্প উদ্যোগের নিরাপত্তার জন্যে মাইক্রো ইন্স্যুরেন্সের সুযোগ থাকা খুবই জরুরি। ব্র্যাকের পরিচালক নবনীতা চৌধুরীর সঞ্চালনায় এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম, কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক, তরঙ্গের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনূর ইয়াসমিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সমীক্ষার ফলাফল উপস্থাপন করেন ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ।