জাতীয়
ঢালাও অভিযোগ-মামলায় ‘ভিন্ন উদ্দেশ্য’ দেখছে পুলিশ
রিপোর্ট দেশ জনপদ ॥ টেকনাফে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান নিহতের ঘটনার পর পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা মহলে সমালোচনার ঝড় বইছে। এরই মধ্যে চাঁদাবাজি, হত্যা, নির্যাতন, ক্রসফায়ারসহ নানা অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অন্তত দুই ডজন মামলা হয়েছে। সিনহা হত্যাকাণ্ডসহ পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও মামলা ‘বিব্রতকর’ মনে করছেন পুলিশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা। হঠাৎ পুলিশের বিরুদ্ধে এহেন চেষ্টায় ‘ভিন্ন উদ্দেশ্য’ও দেখছেন তারা। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যক্তি পুলিশের দায় কখনও বাহিনী নেবে না। বাহিনীর যেকোনো সদস্য অপরাধী প্রমাণিত হলে তার শাস্তি হবে অপরাধী হিসেবেই। গড়পড়তা সমালোচনা, পুলিশবিরোধী বিষোদগার কিংবা হঠাৎ নানা অভিযোগে মামলার ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। সেনা কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর নানামুখী সমালোচনা ও মামলার মধ্যে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ‘সেনাবাহিনী ও পুলিশ এ দুটি ঐতিহ্যবাহী ও ভ্রাতৃপ্রতিম বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপপ্রয়াস চলছে।’ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, জনবান্ধব ও গণমুখী পুলিশ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা ও উৎসাহ অব্যাহত রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংগঠনটি। অন্যদিকে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুঃখজনক উল্লেখ করে ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জোর দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ সমিতি। তবে ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু কিছু প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে ব্যবহার করে একটি স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অপপ্রচার চালিয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য তৎপর বলে মনে করছে সংগঠনটি। কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর পুলিশ তল্লাশি চৌকিতে গত ৩১ জুলাই রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬)। ওই ঘটনার বিচার চেয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন তার বড় বোন শারমিন। মামলাটি তদন্ত করে আদালতকে জানানোর জন্য র্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের অধিনায়ককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের যৌথ তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। গত ৪ আগস্ট থেকে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন তারা। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও গণশুনানি শুরু করেছেন কমিটির সদস্যরা। সেনাবাহিনীর প্রধান ও পুলিশের আইজিপি উভয়ই ঘটনাটিকে ‘একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়ভার বাহিনী নেবে না বলেও জানান তারা। এদিকে সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করছেন ভুক্তভোগীরা। গত বুধবার (১৯ আগস্ট) ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে অর্থ দাবি এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ব্যবসায়ী মো. আবদুল ওয়াহেদ। গত ১৮ আগস্ট পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ আদায়ের পর আরও পাঁচ লাখ টাকা না দেয়ায় বন্দুকযুদ্ধের নামে কক্সবাজারের টেকনাফের সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবককে হত্যার অভিযোগে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মা গুল চেহের। গত ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় এক প্রবাসীকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগে চকরিয়া থানার ওসিসহ দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন নিহতের মামা মুক্তিযোদ্ধা আহমদ নবী। গত ১৩ আগস্ট চাঁদাবাজির অভিযোগে আদালতে রাজধানীর কদমতলী থানার এসআই নাজমুলসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক ব্যবসায়ী। নেতাকর্মীদের বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে থানায় এনে শারীরিক অত্যাচার, নির্যাতন, টাকা দাবি, মাদক, চাঁদাবাজি বা পেইন্ডিং মামলার আসামি করে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থানার ওসির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে গত ১২ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করেন ভাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এমদাদুল হক। একই দিন ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে আদালতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী হারুন মিয়া। এছাড়া চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজশাহী রেঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) বেলায়েত হোসেনসহ অজ্ঞাতনামা ১৫-১৬ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন এক ব্যবসায়ী। গত ১০ আগস্ট ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক ব্যবসায়ী। একই দিন কক্সবাজারের খরুলিয়া বাজার এলাকায় গণধোলাইয়ের পর থানা হেফাজতে মারা যান নবী হোসেন (৩৮) নামের এক ইয়াবা ব্যবসায়ী। ওই ঘটনায় সদর থানা পুলিশের ওসিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সবকিছু ছাপিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহার সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথের ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়ায় সাতক্ষীরার এসপি এবং পিবিআইর এক এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। এনিয়ে হাইকোর্টে রিটও করা হয়। যদিও ২০ আগস্ট হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রিটটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। এসব বিষয়ে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ২৪ ঘণ্টাই জানমালের নিরাপত্তায় কাজ করে। করোনায় পুলিশ কী করেনি? সব ভুলে একটি ইস্যুতে পুরো বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো অত্যন্ত দুঃখজনক। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে পুলিশকে বিব্রত করার চেষ্টা চলছে। কোনো অবস্থায়ই ব্যক্তি পুলিশে অপরাধের দায় পুরো বাহিনীর নয়। বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। যদিও তদন্ত ও বিচারের আগেই একটি কুচক্রিমহল সুযোগ নিয়ে পুলিশবিরোধী বিষোদগার ও মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। আমাদের বক্তব্য হলো- পুলিশ কখনও অপরাধ ও অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয় না। এ ব্যাপারে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, ‘রাষ্ট্র পুলিশকে জানমালের নিরাপত্তায় পাওয়ার (ক্ষমতা) দিয়েছে। তো পাওয়ার থাকলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগও উঠবে। অভিযোগ মানেই দোষী নয়। যেকোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্ত হয়। তদন্তে দোষী হলে শাস্তি, নির্দোষ হলে মুক্তি। কেউ বিব্রত করার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু এতে বিব্রত হওয়ার কিছু নেই।’ সাবেক আইজিপি শহীদুল হক একটু ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ কখনও-ই ব্যক্তি অপরাধের দায় নেয়নি। নেবেও না। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকেই পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। পুলিশে যারা কাজ করেন তারাও তো মানুষ। ভুল বা অপরাধ যেকোনো ব্যক্তিরই হতে পারে। কিন্তু পুলিশ বলে অনেকেই উঠেপড়ে লাগার চেষ্টা করেন। ইস্যু পেলে অনেকেই পুরো বাহিনীকে বিব্রত করার চেষ্টা করেন। এটা খুবই দুঃখজনক, নিমিষেই পুলিশের ভালো দিকগুলো ভুলে যান তারা।’ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ড পুলিশের প্রতি মানুষের অনাস্থা আরও বাড়িয়েছে বলে মত দেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ক্রসফায়ার নিয়ে তো সমালোচনা আছেই। পুলিশ নানা অপরাধে জড়িত, তা-ও প্রমাণিত। থানার ওসিদের অনেকের-ই বিরুদ্ধে অভিযোগ। পুলিশের কর্মকাণ্ডে সরকার বিব্রত আগে থেকেই। আর মেজর (অব.) সিনহার ঘটনা সরকারের অস্বস্তি আরও বাড়িয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে সত্যটি বেরিয়ে আসুক। আস্থা ফিরে আসুক জনমনে এমন প্রত্যাশা রইল। সিনহা হত্যাকাণ্ডের দায় পুরো পুলিশ বাহিনীর ওপর বর্তায় না উল্লেখ করে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা দিয়ে পুলিশের সামগ্রিক চিত্র মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখা হচ্ছে। আশা করছি, তদন্তে সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসবে।