বরিশাল
গণমাধ্যমে চরিত্রহনন ও পাল্টা বিবৃতি
বিএনপির ঘাঁটিতে মনোনয়নযুদ্ধে বিভাজনের রাজনৈতিক ট্র্যাজেডি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন তুমুল আলোচনার কেন্দ্রে। এক সময়ের দলীয় শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসন আজ যেন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কাদা ছোড়াছুড়ি ও গ্রুপিংয়ের মঞ্চে পরিণত হয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিগত অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দলীয় ঐক্য।
ফ্যাসিবাদী সংগঠন আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসনে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত অন্তত ৬ প্রার্থী মনোনয়ন লড়াইয়ে মাঠে নেমেছেন। তাদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে। কথাই লড়াই থেকে তাদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন লড়াইয়ে আছেন হাফ ডজনেরও বেশি নেতা। যদিও সাক্ষাতের জন্য এখন পর্যন্ত কেন্দ্রের ডাক পেয়েছেন ৩ জন।
এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত মুখ সাবেক এমপি, দলীয় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার। দল ও জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা সরোয়ার পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও এবার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি একসময় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে কেন্দ্রীয় যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আলাল। ওই সময় সরোয়ারের সঙ্গে আলালের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব ছিল। এলাকায় দুই হেভিওয়েট নেতার আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আলালকে পরবর্তীতে ঢাকার একটি আসন থেকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি।
সবশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন নেননি আলাল। তার যুক্তি ছিল খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে নির্বাচনে যাওয়ার অর্থ হয় না। আলাল বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। আগে কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব পদে ছিলেন। আলালের সমর্থকরা চাচ্ছে তিনি বরিশাল -৫ থেকে এবার নির্বাচন করুক। যদিও গত নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন নেননি, তবে এবার সমর্থকদের চাপে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবায়েদুল হক চাঁন স্থানীয় বিএনপির পোর খাওয়া নেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি জেলা বিএনপির সভাপতি ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে জেল খেটেছেন।এবার তিনিও মনোনয়ন চাইছেন সরোয়ারের আসনে। বরিশাল (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহিন ও মহানগর বিএনপির ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিন ও এই আসন থেকে ভোট করতে চাইছেন। জানা গেছে, কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে দলকে ৭ খণ্ড করে চলছে এদের মনোনয়নের লড়াই। সভা-সমাবেশও চলছে আলাদাভাবে। তবে সম্প্রতি এসব নেতার কয়েকজন মেতেছেন একে অপরের প্রতি বিষোদ্গারে। নিজেকে সৎ প্রমাণ করতে গিয়ে অন্যের চরিত্র হননও করছেন কেউ কেউ।
এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মনোনয়নপ্রার্থী রহমতউল্লাহর বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির দুই নেতার দেওয়া বিবৃতি। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজের ভূমিকা ও ত্যাগের কথা বলার পর তার বিরুদ্ধে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছেন বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান ও সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহিন। তারা রহমতউল্লাহকে ‘জাতীয় পার্টির উচ্ছিষ্টভোগী’ বলে আখ্যা দেন এবং তার আন্দোলনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রহমতউল্লাহ পাল্টা বিবৃতিতে বলেন, “গুটিকয়েক ভিউ পাওয়া একটি সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে সমগ্র গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত।” সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগ এসেছে মহানগর বিএনপির ১নং যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিনের কাছ থেকে।
এক সভায় দেওয়া বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেখানে তিনি সরোয়ার ও আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মনিরুজ্জামান ফারুকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ তোলেন। নাসরিন বলেন, “দরবেশ সেজে বসে আছেন? আপনারা চাঁদাবাজি করবেন, দখলবাজি করবেন আর মানুষ আপনাদের ভোট দেবে? বরিশালের মানুষ কি বোকা?” তিনি আরও বলেন, ফারুকের আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ রয়েছে তার হাতে।
ফারুক তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “২০২১ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর সময় সান্ত্বনা জানাতে আসা দুই আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ছবি তোলাকে কেন্দ্র করে এই অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।” তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “নাসরিনের হাতে এত টাকা কোথা থেকে এল যে, হঠাৎ করে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় বাস কিনলেন?” নাসরিন এর জবাবে বলেন, “আমার পারিবারিকভাবে ব্যবসা রয়েছে, আমি নিজেই বাস কিনেছি। আমার সঙ্গে কোনো ফ্যাসিস্ট নেতার সম্পর্ক নেই।” সরোয়ার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, “সবচেয়ে দুঃখজনক হলো দলের চেইন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে গেছে। মহানগর বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেত্রী কীভাবে এ ধরনের কথা বলেন?”
তিনি আরও বলেন, “আমার ভাইয়েরা বাস টার্মিনালের কোনো নেতৃত্বে নেই। কেউ প্রমাণ করতে পারলে আমি দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নেব।” তৃণমূল পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, দলটি কমপক্ষে সাতটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রতিটি মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আলাদা সভা-সমাবেশ, কর্মী সম্মেলন ও প্রচারণা চলছে। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছে সাধারণ নেতাকর্মীরা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। বরং একে অপরকে নিন্দা ও অভিযোগে পিষে ফেলাই যেন মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির জন্য এই বিভাজন আত্মঘাতী হতে পারে। বিশেষ করে হেভিওয়েট ও অভিজ্ঞ নেতৃত্বের এমন প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের ফলে সাধারণ ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে।
বরিশাল-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন লড়াই এখন আর কেবল একটি আসন জয়ের বিষয় নয়। এটি হয়ে উঠেছে দলীয় শৃঙ্খলা, নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা এবং রাজনৈতিক পরিপক্বতার পরীক্ষা। যে দল গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলে, সেই দলের অভ্যন্তরেই যদি অগণতান্ত্রিক আচরণ, কাদা ছোড়াছুড়ি ও একে অপরকে হেয় করার প্রবণতা চলে তাহলে জনগণ কতটা আস্থা রাখবে, সেটি এখন সময়ের প্রশ্ন।