কলাপাড়া
কুয়াকাটয় বাড়ছে পর্যটকের প্রাণহানি
কুয়াকাটা সৈকত রক্ষায় স্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রকল্প দুই যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু পরিকল্পনা প্রস্তাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এছাড়া জরুরি মেরামতের নামে জিওব্যাগ, জিওটিউব স্থাপনসহ নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়েও এখন চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। কারণ এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সৈকতে বালু খনন করে ওই বালু জিওব্যাগ ও জিওটিউবে দেওয়ায় সৈকতে কুয়া হয়ে গেছে। বিচটি এবড়ো-থেবড়ো হয়ে গেছে।
জোয়ারের সময় এসব কুয়া এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। সবশেষ শূন্য পয়েন্টে সরদার মার্কেট ঘেঁষা সৈকতে বুধবার বেলা ১১টার দিকে বন্ধুদের সঙ্গে গোসলে নেমে পর্যটক মিয়া সামাদ সিদ্দিকী ওরফে পারভেজের (১৭) সলিল সমাধি ঘটে। ঘূর্ণিস্রোতে ভেসে যাওয়া ওই পর্যটককে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন।
নিহত পর্যটক মাগুরা জেলার হাজীপুর পশ্চিম বাড়িয়াল এলাকার অলিউল ইসলামের ছেলে। তিনি খুলনার খালিশপুরে ‘সেভ আওয়ার সোল (এসওএস) ইয়ুথ হাউস’ নামের একটি বেসরকারি এতিমখানায় অফিস প্রোগ্রামার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন।
এ বছরের ২৫ জুলাই ভেসে যাওয়ার প্রাক্কালে শূন্য পয়েন্টে তানভির (২৩) নামের এক পর্যটককে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এভাবে প্রতি বছর সৈকতে গোসলে ভেসে যাওয়ার খবর মিলছে।
স্থানীয়রা ও পর্যটকরা কুয়াকাটা সৈকতের শূন্য পয়েন্ট থেকে আশপাশ এলাকাকে জোয়ারের সময় গোসলের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে করছেন। কেউ কেউ মৃত্যুকূপও মনে করছেন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতটি এখন নদীর পাড়ের মতো হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় ওয়াকিং জোন নেই। বিশেষ করে ট্যুরিজম পার্ক থেকে মিরাবাড়ি পর্যন্ত সৈকতটি জোয়ারের সময় পর্যটকের জন্য ঝুঁকি বহুগুণে বেড়েছে।
এই তিন কিলোমিটার এলাকার ভাঙন রক্ষার নামে গত এক যুগে যে যার মতো বালু উত্তোলন করে এবড়ো-থেবড়ো করে দিয়েছে। স্থানীয়রা বাধা দিলে বলা হয়েছে, জোয়ারের সময় লেভেল হয়ে যাবে। এছাড়া এই সৈকত থেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বালু উত্তোলন করে ব্যবসা-বাণিজ্য করা হয়েছে। ফলে শূন্য পয়েন্টে গোসলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে গেছে।
অপরদিকে সৈকতের মিরাবাড়ি থেকে পশ্চিম দিকের খাজুরা পর্যন্ত এবং ট্যুরিজম পার্ক থেকে গঙ্গামতি পর্যন্ত জোয়ারের সময় সৈকত অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। একই অবস্থা ঝাউবাগান থেকে পূর্ব দিকের সৈকতের। এখানটার স্লোপ এবড়ো-থেবড়ো নয়। স্লোপ লেভেল ভাটার সময় চোখে দেখলেই এই ব্যত্যয় দেখা যায়।
আব্দুর রশিদ নামের এক খুটা জেলে দাবি করেন, বালু উত্তোলন ছাড়াও ২০২১ সাল থেকে পায়রা বন্দরের চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার পর থেকে সাগরের ভাঙন বহুগুণে বেড়ে গেছে। স্রোতের তোড় এখন কিনার থেকে যায়।
ফলে ভাঙন বেড়েছে। তবে তার এই ধারণাভিত্তিক অভিযোগের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহ আলম জানান, জরুরি প্রটেকশনের জন্য সঠিকভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখানে জিওব্যাগ ও জিওটিউবের কোনো বিকল্প নেই।
এছাড়া বিচের বেলাভূমিতে দেওয়া পুরনো জিওব্যাগ এখন অপসারণ করা হবে আত্মঘাতী। কেননা, বালুতে অর্ধেক দেবে যাওয়া জিওব্যাগ ঢেউয়ের ঝাপটা প্রতিরোধ করছে।
আর তুলে ফেললে সৈকত আরও দ্রুত সাগরে বিলীন হবে। তবে পর্যটক-দর্শনার্থীকে গোসলের জন্য সতর্ক অবস্থান ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে সৈকতের বালু কেউ তুললে এটি বন্ধ করতে হবে। আর স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে তিনি জানান।
সূত্র মতে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ১৭ দশমিক ২৫০তম কিলোমিটার থেকে ৩৭ দশমিক ২৫০তম কিমি পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরের দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার মূলত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত এলাকা নির্ধারণ করা রয়েছে।
এর মধ্যে গঙ্গামতি লেকের ২৪ দশমিক ২৫০তম কিমি থেকে আন্ধারমানিক নদী মোহনার ৩৪ দশমিক ৭৫০তম কিমি পর্যন্ত সাড়ে দশ কিলোমিটার সৈকত সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। যেখানে মূলত পর্যটকরা বিচরণ করেন।
এই সাড়ে দশ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার থেকে ৩২ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচ দশমিক এক কিলোমিটার সাগরের তীব্র ভাঙন এলাকা। বর্তমানে সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ পাঁচ কিলোমিটার অংশের মধ্যে আড়াই কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ পুরো পাঁচ কিলোমিটার জরুরিভাবে প্রটেকশন দেওয়া হয়নি। মূলত শূন্য পয়েন্টের আশপাশের স্থাপনা রক্ষার নামে বর্ষা মৌসুমের আগে আগে এই জরুরি প্রটেকশন দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এ বছরও বরাবরের মতো ট্যুরিজম পার্ক থেকে ২৯ দশমিক ৫০০ মিটার থেকে ৩০ দশমিক ৬০০তম অংশের এক কিলোমিটার একশ মিটার এলাকা খুবই বিধ্বস্ত দশায় রয়েছে।
কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড ট্যুরিজম পার্ক থেকে শূন্য পয়েন্ট পর্যন্ত দুই-তিন শ’ মিটার এলাকা জিওটিউব দিয়ে সাময়িক প্রটেকশন দিচ্ছে। যা নিয়েও স্থানীয়দের প্রশ্ন রয়েছে।
কারণ সাগরের বেলাভূমি থেকে ড্রেজার লাগিয়ে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এছাড়া কেন বর্ষা মৌসুমের আগেই এই প্রটেকশন দেওয়া হলো না, এ নিয়ে মানুষ ক্ষুব্ধ মনোভাব পোষণ করেন।
পরিবেশ ও উন্নয়ন কর্মী কেএম বাচ্চু জানান, বর্তমানে সীবিচটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। প্রশস্ত বিচটি জোয়ারের সময় ব্যবহৃত হয় না, শুধু গোসল করতে পারে। ভাটায় পর্যটক বিচ ব্যবহার করতে পারে।
এই বিচকে পুঁজি করে অনেকে বালুর ব্যবসা করেছে। বর্তমানে ছেঁড়া, শ্যাওলা ধরা টিউব ও জিওব্যাগের মাঝখানে গর্ত হয়ে গেছে। জোয়ারের সময় ওই সমস্ত জায়গায় ঘূর্ণিস্রোত তৈরি হয়।
যেখানে পর্যটকরা ভেসে প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেই চলছে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষায় সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে। স্থায়ী প্রটেকশন বাস্তবায়নের দাবি তার।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মোতালেব শরীফ জানান, সৈকতের শূন্য পয়েন্টে জিওব্যাগ দেওয়া হয়েছে সৈকতের বালু কেটে। সৈকত ঢালু হয়ে গেছে। ব্যাগের আশপাশে জোয়ারের সময় ঢেউয়ের তোড়ে ঘূর্ণিস্রোত হয়। সেখানে পর্যটকরা পড়ে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে। স্থায়ী প্রটেকশন না দিলে বড় ধরনের সর্বনাশ হবে সৈকতের।
পাথর কিংবা ব্লক দিয়ে স্থায়ী প্রটেকশন দেওয়া প্রয়োজন বলে তার দাবি। তারা বিষয়টি বারবার মৌখিক ও লিখিতভাবে সরকারের কাছে জানিয়েছেন। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তারা হতাশা ব্যক্ত করেন ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ও কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. ইয়াসীন সাদেক জানান, বিচ থেকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে বালু তুললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া শূন্য পয়েন্টে গোসলে সতর্ক থাকার জন্য পর্যটক-দর্শনার্থীর জন্য সচেতনতামূলক বিলবোর্ড দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। গোসলের জন্য শূন্য পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ থাকলে এটি এড়ানো যায় কি না, তা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।