বরিশাল
ফের আ.লীগের দোসর হিরা মাতুব্বরের নিয়ন্ত্রনে বেলতলা খেয়াঘাট!
নিজস্ব প্রতিবেদক : বিগত আওয়ামী লীগের আমলে বরিশাল সদর উপজেলার কীর্তনখোলা (বেলতলা) খেয়াঘাট নিয়ন্ত্রন করেছিলেন আওয়ামী লীগের দোসর হিরা মাতুব্বর। সেসময় নানা অরাজকতার মাধ্যমে যাত্রীদের জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করতেন তিনি। তার অরাজকতার হাত থেকে মুক্তি পেতে ঘাটের ইজারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন নামেন চরমোনাই ইউনিয়নের বাসিন্দারা। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। চলতি বছরেও ইজারা বাগিয়ে নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে নানা মহলে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠছে।
বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ফেরিঘাট থেকে নগরীর বেলতলা খেয়াঘাটে ট্রলারে ১০ মিনিটের পথ। এই পথে যাত্রীদের ছিল আট টাকা, আন্দোলন করে ইজারার দর কমালেও জনপ্রতি ভাড়া কমালেও অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া আগের নির্ধারিত রেটেই আদায় করা হচ্ছে। তবে রাত বাড়লে দ্বিগুণের বেশি নেওয়া হয়। অর্থাৎ ২০ টাকা করে গুনতে হয় জনপ্রতি। এখানে দরদামের সুযোগ নেই। ফেরি থাকলেও চলে না। ব্যবহার হয় ট্রলারে ওঠানামার ঘাট হিসেবে।
এভাবে প্রতিদিন চরমোনাই ইউনিয়নের ৯ গ্রামের বাসিন্দা, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার যাত্রীদের জিম্মি করে ইচ্ছেমতো পকেট কাটছেন ট্রলারচালক ও ঘাটের ইজারাদার। বাড়তি ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে চালকদের বাগবিতণ্ডাও হয়। মোটরসাইকেল প্রতি ভাড়া দিতে হয় ২০ টাকা।এছাড়া ভ্যান থেকে শুরু করে সাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনকে আলাদা ভাড়া দিতে হয়। এক্ষেত্রে ভাড়া দিতে হয় ওজন হিসাব করে। ইজারাদারের বেঁধে দেওয়া ভাড়াই দিতে বাধ্য থাকেন যাত্রীরা। আন্দোলন করেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি। কারণ ইজারাদার হিরা মাতুব্বর বিগত আমলে ছিলেন আওয়ামী লীগের দোসর, আর ৫ আগষ্ট সরকার পতনের পর তিনি ভোলপাল্টে বিএনপি নেতাদের ম্যানেজ করে ফের ঘাট ইজারা নিয়েছেন।
জানা গেছে- বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হিরা মাতুব্বর বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্টজন ছিলেন। তিনি একাধিক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে তার বেশ কিছু ছবি প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
সাদিক আবদুল্লাহর আস্থাভাজন হওয়ার সুবাদে বিগত দিনে তিনি বেলতলা খেয়াঘাটের ইজারা বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি ২০২৩ সালে কীর্তনখোলা (বেলতলা) খেয়াঘাটের ইজারা নিয়ে বরিশাল জেলা পরিষদের নাটকীয়তায় ঘাট ইজারা পান হিরা মাতুব্বর। তৎকালিন বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তখন সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েও কীর্তনখোলা (বেলতলা) খেয়াঘাটের ইজারা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন মোঃ কামাল।
জানা গেছে- বিগত ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলা পরিষদের মালিকানাধীন ১৯টি খেয়াঘাট ১ বছরের জন্য ইজারা প্রদানের লক্ষে দরপত্র আহবান করেছিল। পরদিন ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টার মধ্যে দরপত্র জমা দেয়ার সময় নির্ধারিত হয়েছিল এবং ওই দিনই বিকাল ৩টার সময় দরপত্র খোলা হয়েছিল। তখন বরিশালের কীর্তনখোলা নদীস্থ বেলতলা খেয়াঘাটের দরপত্রও খোলা হয়। ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ডেকে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মো. কামাল নির্বাচিত হন অপরদিকে ৯৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা ডেকেছিলেন হিরা মাতুব্বর।
সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দরদাতাই প্রাপ্য হবে ওই ঘাটের এবং নিয়মানুযায়ী ১৪/১৫ দিনের মধ্যে সিএস হওয়ার কথা থাকলেও মো. কামালকে ডাকা হয়নি এবং সিএসও করা হয়নি। তবে দ্বিতীয় দরদাতা হিসেবে হিরা মাতুব্বর থাকলেও তাকে গোপনে খেয়া ঘাটের ডাক বুঝিয়ে দিয়েছিল জেলা পরিষদ। পরে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গোলাম সরোয়ার রাজিব গিয়ে ঘাট উদ্বোধন করে দিয়েছিলেন।
এরপর ২০২৪ সালেও এককভাবে ঘাট ইজারা নেন হিরা মাতুব্বর। তখন বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীরের যোগসাজসে ৪ টাকার ভাড়া বাড়িয়ে ৮ টাকা করেছিলেন। সে সময় যাত্রীরা ক্ষুব্দ হলেও মুখ খোলার সাহস ছিল না কারোর।
এদিকে পেশাদার পাটনি না হয়ে নিজেকে পাটনি দেখিয়ে ডাক নিয়ে জালিয়াতি করেছেন হিরা মাতুব্বর। নিয়ম অনুসারে খেয়াঘাটের ইজারা নিতে হলে ইজারাদারকে পেশাদার পাটনি হতে হবে। কিন্তু হিরা মাতুব্বর পেশাদার পাটনি নন।
চলতি বছরে বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতার নাম ভাঙিয়ে ও বরিশাল মহানগর বিএনপির এক নেতাকে ম্যানেজ করে ঘাট ইজারা নেন হিরা মাতুব্বর। তবে ঘাট ইজারা দেওয়ার আগে ঘাটের ইজারা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন নামেন চরমোনাই ইউনিয়নের বাসিন্দারা। নানা কর্মসূচি পালন করলেও ঘাটের ইজারা বাতিল না করে ইজারার দর কমিয়ে দেয় জেলা পরিষদ। সরকার নির্ধারিত ইজারা দর ১ কোটি ২১ লাখ থাকলেও আন্দোলনের মুখে তা ৮৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারন করা হয়। কিন্তু আন্দোলনে ইজারা দর কমলেও সে সুফল ভোগ করতে পারছেনা চরমোনাই ইউনিয়নে বাসিন্দারা। জনপ্রতি ভাড়া ৫ টাকা নিলেও অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া আগের নির্ধারিত রেটেই আদায় করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করতে গেলেই সরকারি কাজে বাধা দেওয়া হচ্ছে বলে হুমকি দিয়ে নিবৃত করা হয় চরমোনাই ইউনিয়নে বাসিন্দাদের।
চরমোনাই ইউনিয়নের বাসিন্দা দিনমজুর মো. মোসলেম উদ্দিন বলেন, ‘কাজ করতে প্রতিদিন সকালে ট্রলারে করে নগরীতে যেতে হয়। কাজ শেষে রাতে বাড়িতে ফিরতে হয়। এতে সকালে যাওয়ার সময় পাঁচ এবং রাতে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। মাঝেমধ্যে রাতের ভাড়া আরও বেশিও গুনতে হয়। ইচ্ছেমতো ভাড়া নেন ট্রলারচালকরা। কারও কাছে অভিযোগ দিলেও কোনও কাজ হয় না। আন্দোলন করেও সুফল পাইনি।’
ঘাটের ইজারাদার হীরা মাতুব্বর বলেন, আমি কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নই। আপনি (প্রতিবেদক) খোঁজ নিয়ে দেখেন। আমি ব্যবসা করি, ব্যবসার সুবাদে সবার সাথেই সুসম্পর্ক রাখতে হয়। সে সুবাদে ছবি থাকতেই পারে। এটা দোষের কিছু না।
ঘাট ভাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- ট্রলারে ২৪ ঘণ্টা কর্মচারী রাখতে হয়। ট্রলার এবং দুই ঘাটে প্রতিদিন ২০ জন লোক কাজ করে। তাদের বেতন থেকে শুরু করে ট্রলার মেরামত এবং ডিজেলে বড় অংকের টাকা খরচ হয়। যাত্রীদের ভাড়া জেলা পরিষদ থেকে নির্ধারিত। রাতে যাত্রী কম থাকায় ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়া হয়।’
জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা ইন্তিয়াজ মাহমুদ বলেন, বেলতলা খেয়াঘাট সরকারি নিয়মে ইজারা দেয়া হয়েছে। বিগত দিনে কি হয়েছে তা আমি বলতে পারবো না। আমি নতুন এসেছি।