বরিশাল
বরিশালে ওসি জোবায়েরের মৃ’ত্যু, ফেঁসে যেতে পারেন ইন্সপেক্টর সগির ও অজ্ঞাত নারী!
নিজস্ব প্রতিবেদক : ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের ইন্সপেক্টর মোঃ সগির হোসেনের বিরুদ্ধে। নগরীর একাধিক আবাসিক হোটেলে তার শেয়ার রয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে কৌশলী এ পুলিশ কর্মকর্তা নিজেকে ধরা ছোয়ার বাইরে রাখতে নানা কুট কৌশল অবলম্বন করেছেন। সম্প্রতি নগরীর আবাসিক হোটেল সামসে সাতক্ষীরার কাটাখালি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জোবায়ের হোসেনের মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। তার মৃত্যুতে ফেঁসে যেতে পারেন ইন্সপেক্টর সগির ও অজ্ঞাত এক নারী।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে- ইন্সপেক্টর মোঃ সগির হোসেন দীর্ঘদিন যাবত বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত রয়েছেন। গত বছরের ৫ আগষ্ট সরকার পরিবর্তনের পর নতুন সরকার বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীতেও এনেছে বড় ধরনের সংস্কার। তবে ইন্সপেক্টর মোঃ সগির হোসেন হাসিনা সরকারের আমলে পাহাড় সমান অপকর্ম করেও এখনো রয়েছেন বহাল তবিয়তে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।
এদিকে ইন্সপেক্টর সগির হোটেল ব্যবসায় জড়িত থাকায় ও কোতয়ালী মডেল থানার ওসি মিজানুর রহমান তার ব্যাচমেট হওয়ায় এসব হোটেলগুলো কোন প্রকার অভিযান পরিচালনা করা হয় না। তাই অনেক পুলিশ কর্মকর্তা তার হোটেলে অবস্থান নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। সেই সুবাদে গত সোমবার (৭ এপ্রিল) রাতে তার ব্যাচমেট সাতক্ষীরার কাটাখালি হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জোবায়ের হোসেন হোটেল সামসে ওঠেন। তবে রেজিট্রি খাতায় এন্ট্রি ছিল না তার। পর দিন সকাল ৮ টার দিকে জুবায়ের নাস্তা করতে নেমে ৯টার দিকে সেখানে নিজের স্ত্রী পরিচয়ে এক নারীকে নিয়ে আসেন। এরপর বেলা ১২ দিকে জোবায়ের হোসেন অসুস্থ হয়ে পড়লে ওই নারী ডাক-চিৎকার দিয়ে হোটেলের লোকজন ডেকে পালিয়ে যান। তার মৃত্যু হোটেলে হলেও তাকে নাটকীয়তাভাবে হোটেল সামসের মালিক মানিক ইন্সপেক্টর সগিকে জানায়। সগির আবার কোতয়ালি মডেল থানা পুলিশকে জানালে থানার গাড়িতে করে তাকে মেডিকেল নিয়ে গেলে সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক ওসি জোবায়েরকে মৃত ঘোষণা করে।
তবে ওই নারী তার স্ত্রী নন, সে তারই নিকট এক আত্মীয়ের স্ত্রী বলে জানা গেছে। তবে জোবায়ের হোসেনের বরিশালে একটি ফ্লাট রয়েছে, সেখানে তার পরিবার থাকলেও তাদের কিছু না জানিয়ে তিনি ওই হোটেলে অবস্থান নেন।
এদিকে হোটেল সামসের ম্যানেজার রুবেল জানান- সগির স্যার আমাদের এই হোটেলের মালিকানার অংশীদার। আর আমরা তার নির্দেশনা মত কাজ করে থাকি। ওসি জোবায়ের স্যারের মৃত্যু হলে সগির স্যারের নির্দেশে আমি হোটেলের রেজিস্ট্রার খাতায় জোবায়ের স্যারের নাম লিপিবদ্ধ করে রাখি। সগির স্যার জানে জোবায়ের স্যারের রুমে কোন মেয়ে এসেছিল। ওসি জুবায়ের স্যার মারা গেলে আমরা আমাদের হোটেল পার্টনার সগির স্যারকে আগে জানাই। সগির স্যার কোতয়ালী মডেল থানার ওসি স্যারকে জানিয়ে গাড়ি এনে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমরা আসলে সগির স্যারের উপরে কথা বলতে পারি না। তিনি যেভাবে বলে আমরা সেভাবে করে থাকি। হোটেল সামসের ম্যানেজারের দেয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিও প্রতিবেদকে কাছে রয়েছে।
জানা গেছে- মাদক ব্যবসায়ীদের শেল্টার দিয়ে মাসোয়ারা নেওয়া হলো সগিরের পেশা ও নেশা। বরিশাল মেট্রোপলিটনের কাউনিয়া থানার ইন্সপেক্টর অপারেশন ও তদন্তের দ্বায়িত্বে থাকা অবস্থায় অবৈধ ব্যবসায়ীদের সাথে সখ্যতা গড়ে কামিয়েছেন কোটি টাকা। মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ ঝাটকা ব্যবসায়ীদের থেকে মাসোয়ারা নিয়ে অবৈধ ব্যবসার সুযোগ করে দিতেন সগির। বর্তমানে বরিশাল মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টরের দ্বায়িত্ব নিয়ে বরিশাল জেলার গৌরনদী থেকে শেখ মাহাবুব নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে বিপুল পরিমান মাদকসহ আটক করে এয়ারপোর্ট থানায় আটক দেখিয়ে উদ্ধারকৃত মাদকের নামমাত্র জব্দ দেখিয়ে বাকি মাদক হীরা মাঝির কাছে মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীর।
ইন্সপেক্টর সগির কাউনিয়ার মাদক ব্যবসায়ী কালামের বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী কালামকে না পেয়ে কালামের স্ত্রীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি সংবাদকর্মীরা জানলে সগির ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন- ২০ হাজার টাকা নিয়েছি, ৩০ হাজার নয়।
অভিযোগ রয়েছে- ইন্সপেক্টর সগির বরিশাল নগরীর সদর রোড এলাকার আবাসিক হোটেল ‘হোটেল সামস্’, পোর্ট রোড এলাকার আবাসিক হোটেল ‘রোদেলা’, গির্জা মহল্লা এলাকার আবাসিক হোটেল ‘ইম্পেরিয় ও আবাসিক হোটেল আজিজিয়াসহ একাধিক আবাসিক হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন। এ সব আবাসিক হোটেলে জুয়া খেলাসহ নানা অপকর্ম হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আর তার এ হোটেল ব্যবসা দেখাশোনা করেন মানিক নামের এক ব্যক্তি। কৌশলগত কারণে কাগজে-কলমে এসব হোটেলের মালিকানা মানিকের নামে রয়েছে। আর এই মানিক নিজেকে ইন্সপেক্টর সগিরের ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। মানিক তার কোন নিকট আত্মীয় নয় বলে জানা গেছে।
আরও অভিযোগ রয়েছে- তিনি মাদক অভিযানে উদ্ধারকৃত মাদক অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির সাথে জড়িত আছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়াও অধিনস্থ পুলিশ সদস্যদের মাধ্যমে মাদক অভিযানে আটক বাণিজ্যের মাধ্যমে উচ্চ মাত্রায় ঘুষ গ্রহণের একাধিক তথ্য পাওয়া যায়। এদিকে তার বিরুদ্ধে মামলা তদন্ত সংক্রান্তে বাদী-বিবাদীর কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা গ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে।
বেশ কিছুদিন আগে নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে অভিযান চালিয়ে একাধিক জুয়ারিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে ইন্সপেক্টর সগিরের বিরুদ্ধে। যার বেশ কয়েকটি ভিডিও চিত্রসহ তথ্য প্রমাণ রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে।
সম্প্রতি নির্ধারিত এলাকার বাইরে অভিযান চালিয়ে মাদকসহ নারী ব্যবসায়ীকে আটকের পর ছেড়ে দেওয়ার ঘটনায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছে বরিশাল নগর গোয়েন্দা পুলিশের এএসআই আউয়াল। ছেড়ে দেওয়ার আগে আটক নারীর সঙ্গে থাকা অসংখ্য ইয়াবা ও নগদ ৭৪ হাজার টাকা রেখে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এএসআই আউয়ালের টিম ইনচার্জ ছিলেন ইন্সপেক্টর সগির। নিজেকে রক্ষার্থে এএসআই আউয়ালের বিরুদ্ধে পুলিশ কমিশনার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। তার দেয়া অভিযোগটি নিয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের মধ্যে নানা গুঞ্জন উঠেছে। অনেকেই বলছেন- এরকম ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি। টিম ইনচার্জ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে কাউকে বরখাস্ত করিয়েছেন এমন নজির নেই। তবে কি কারণে ইন্সপেক্টর সগির এমনটা করলো তা সুষ্ঠু তদন্ত করলে বের হয়ে আসবে।
এ বিষয়ে ইন্সপেক্টর সগিরের ভাই পরিচয় দেয়া মানিক বলেন- সগির ভাইর সাথে ১৪ বছরের সম্পর্ক। সে আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি। হোটেল ব্যবসার সাথে সে জড়িত নয়, তবে টাকা-পয়সার দরকার হলে তার কাছ থেকে নিয়ে থাকি, সব সময়তো হাতে টাকা থাকেনা। সংবাদ প্রকাশ করার দরকার নেই। আপনার (প্রতিবেদক) বিষয়টা আমি দেখবো। আমার সাথে সম্পর্ক করলে আপনার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ইন্সপেক্টর মোঃ সগির হোসেন বলেন- আমি কোন হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত নই। আমার নামে কোন চুক্তিপত্র নেই। মানিক আমার আত্মীয় তাই মাঝে মধ্যে তার ওখানে যাই। তার সাথে সম্পর্ক থাকাতো দোষের কিছু না। এছাড়া বাকি অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি এই পুলিশ কর্মকর্তার।
কোতয়ালী থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন- আমাকে জোবায়েরের অসুস্থতার বিষয়ে জানালে আমি তাকে গাড়ি পাঠিয়ে মেডিকেল নিয়ে যাই।জুবায়েরের মৃত্যুতে একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে তার উপর নির্ভর করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেন- ইন্সপেক্টরের মৃত্যুতে ময়নাতদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের প্রশাসনের কেউ যদি অবৈধ হোটেল ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে তদন্ত করে তারও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওসি জুবায়ের মৃত্যুতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ অভিযোগ করলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান এ পুলিশ কর্মকর্তা।