বরিশাল
অনিয়ম ও দুর্নীতির আতুরঘর বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার অফিস
নিজস্ব প্রতিবেদক : ‘আমি ও আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’– বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয় চত্বরে ঝুলছে এমন সাইনবোর্ড। তবে বাস্তবতা উল্টো, রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। এখানে কর্মচারীর মুখ থেকে কথা বের করতেও দেখাতে হয় টাকার চেহারা! সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরে টেবিলে টাকা ফেললে যেভাবে চাইবেন, সবকিছু মিলবে সেভাবে। ওপর মহলের ছায়ায় সেখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। নামজারি, খতিয়ান, ডিসিআর, খাজনার রসিদ কিংবা ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র সবই যেন তাদের ‘হাতের মোয়া’। তবে দেশের পট পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন আসেনি বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ে।
কেউ জমি নিবন্ধন করতে এলে সরকার নির্ধারিত ফির বদলে নির্ধারিত টাকার ছক ধরিয়ে দেওয়া হয়। এর পর নানা বাহানায় আদায় করা হয় টাকা। বছরের পর বছর চলছে এভাবেই। বেশ কিছুদিন এ সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় ঘুরে পাওয়া গেছে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগের সত্যতা। এর নেপথ্যে রয়েছেন জেলা রেজিস্ট্রার মো: মোহছেন মিয়া ও বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। এরআগে বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোলের সিমাহীন দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলে গত ১২ আগষ্ট ছাত্র-জনতার তোপের মূখে পড়ে অফিস ছেড়ে কৌশলে পালিয়ে যান তিনি। তবে সেসময় অবসরে যাওয়ার কথা থাকলেও তার চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। বেশ কিছুদিন পর আবার স্বপদে বহাল হন এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
দলিল লেখক সমিতির একাধিক নেতার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বরিশাল সদর রেজিস্ট্রি কার্যালয়ে প্রতিদিন ৭০থেকে ৮০টি দলিল রেজিস্ট্রি হয়। সেই হিসাবে বছরে গড়ে ২২০ কার্যদিবস ধরা হলেও রেজিস্ট্রি দলিলের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭ হাজারের বেশি। অন্য দলিলে নির্দিষ্ট অঙ্কের (প্রতি লাখে ১ হাজার) টাকা ঘুষ নেওয়া হলেও বেশি টাকা গুনতে হয় সাফ কবলা, দানপত্র ঘোষণা, ভুল সংশোধন, বণ্টননামা, অসিয়তনামা ও আমমোক্তারনামায়। এখানে ঘুষের হার প্রতিটিতে সর্বনিম্ন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা। সাধারণত সম্পত্তির ভোগদখল, রক্ষণাবেক্ষণ, কেনাবেচার জন্য কাউকে ক্ষমতা অর্পণের জন্য আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) করা হয়। ব্যাংক থেকে রেজিস্ট্রি অফিসে এ দলিল এলে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকার নিচে সেগুলো রেজিস্ট্রি করা হয় না।
সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী বলেন, গত জুনে ঘুষ আদায় হয়েছে অন্তত ৬০ থেকে ৬৫ লাখ টাকা। সেই হিসাবে বছরে ঘুষের অঙ্ক দাঁড়ায় ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা। সাব-রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের অফিস সহকারী থেকে শুরু করে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এ টাকার ভাগ পান। ঘুষের টাকার ২০ শতাংশ নেন জেলা রেজিস্ট্রার মো: মোহছেন মিয়া। ৫০ শতাংশ সাব-রেজিস্ট্রার অসিম কল্লোল, আর ৩০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে ঘুষের টাকার ভাগ সবাই পেয়ে যান।
বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারী, দলিল লেখক ও সেবা নিতে আসা ব্যক্তির বাইরেও অনেক মানুষের জটলা। অফিস চত্বরে ঘুরতে থাকা বেশির ভাগ লোকই দালাল চক্রের সদস্য। তারা কম টাকায় দলিল নিবন্ধন করে দেওয়ার কথা বলে পছন্দের দলিল লেখকের কাছে ‘মক্কেল’ ধরে আনে। বিনিময়ে পায় কমিশন। দেখা যায়, নিবন্ধনের আগে দলিল ঘেঁটে দেখার পর অফিস সহকারী নাদিরা সুলতানা ও পেশকার সুশিল চন্দ্র দলিল লেখকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যে ঘুষের টাকা তুলছেন। এ সময় নিজের পরিচয় দিয়ে অফিস সহকারী নাদিরা সুলতানাকে কী করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জোর করে কিছু নিই না। অনেক ঝামেলার কাজ নিয়ে এসে ক্রেতা-বিক্রেতা নিজেরাই স্বেচ্ছায় বকশিশ দিয়ে যান। আমরা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতে বাধ্য করি– এ অভিযোগ সঠিক নয়।’
অভিযোগ রয়েছে- জেলা রেজিস্ট্রার মো: মোহছেন মিয়া বরিশাল জেলার ১০ টি উপজেলা অফিসের সম্পাদনকৃত দলিল প্রতি ১০০ টাকা করে নিয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রায় ৩০০ দলিল সম্পাদন করা হয়, সে হিসেবে প্রতিদিন শুধু দলিল থেকে ৩০ হাজার টাকা নেন তিনি। এই টাকা সংগ্রহ করেন অফিসের কেরানিরা। সপ্তাহ শেষে ১০ টি অফিসের কেরানিরা এই টাকা পৌঁছানো হয় তার কাছে। নকল প্রতি ৪০০ টাকা নেন রেকর্ড কিপার। যার ৩৫ শতাংশ নেন জেলা রেজিস্ট্রার, ২০ শতাংশ নেন সাব-রেজিস্ট্রার। বাকি টাকা দুই কর্মচারী ভাগ করে নেন। এছাড়াও ১০ টি উপজেলা অফিসের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলেই নানা অজুহাতে টাকা আদায় করেন জেলা রেজিস্ট্রার। টাকা না দিলেই তাদের হয়রানি করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি আইজি অফিসের অজুহাত দিয়ে সেই টাকা আদায় করেন জেলা রেজিষ্ট্রার। অডিট করার নামে প্রতি মাসে প্রত্যেক অফিস থেকে টাকা আদায় করেন তিনি। বছরে দুই অডিটের কথা থাকলেও প্রায় প্রতিমাসে উপজেলা অফিসগুলোতে অডিট করেন তিনি। দলিল লেখকদের লাইসেন্স নবায়ন করার জন্য ১ হাজার টাকা করে নেন মোহছেন মিয়া। সেই টাকা পেশকার সুশিল চন্দ্র রায়ের মাধ্যমে আদায় করানো হয়। জেলা অফিসের অধিনে প্রায় ৬০০ জন দলিল লেখক রয়েছে। তল্লাশ কারকদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য তাদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা করে আদায় করছেন তিনি। ওই অফিসে তল্লাশ কারক রয়েছে ৪০ জন। দলিল কমিশন বাবদ গ্রাহকদের কাছ টাকা নিলেও কৌশলের কমিশন না করে সেই টাকা নিজের পকেটে ভরেন মোহছেন মিয়া। চর-বদনা মৌজার রেকর্ড বন্ধ থাকলেও টাকার বিনিময় প্রতিনিয়ত দলিল হচ্ছে। আর এর বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রেজিস্ট্রি অফিসের অসাধু কর্মকর্তারা।
তবে একাধিক দলিল লেখক জানান, সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কথা বললে সংশ্লিষ্টরা নানা অজুহাত দেখান। আর শুধু জমি রেজিস্ট্রি নয়, দানপত্র, বণ্টনপত্র, ঘোষণাপত্র, অংশনামা ও চুক্তিপত্রের মতো দলিল সম্পাদনের ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ গুণ টাকা দিতে হচ্ছে দাতাগ্রহীতাদের। দলিলের নকল (অনুলিপি) সংগ্রহ করতেও সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা।
একাধিক দলিল লেখক জানান, ১ লাখ টাকা দামের জমি নিবন্ধন করতে সাফকবলার জন্য ৮ হাজার ৫০০ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়। চালানের মাধ্যমে এ টাকা ব্যাংকে দিতে হয়। এর সঙ্গে দলিল লেখকের সম্মানীসহ আরও ২ হাজার টাকা হলেই চলে। তবে সেখানে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এ টাকার মধ্যে সমিতির নামে নেওয়া হয় কিছু টাকা। আর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের জন্য নেওয়া হয় ১ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত। এভাবে জমির দাম বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘুষের টাকার অঙ্কও বাড়তে থাকে। দাবি করা টাকা না দিলে দলিল নিবন্ধন আর সম্ভব হয় না।
চর-বদনা মৌজার এক গ্রাহক বলেন, ‘আমি চর-বদনা মৌজার একখণ্ড রেজিস্ট্রি করতে আসলে সরকারি ফির বাইরে ১ লাখ টাকা সাব-রেজিস্ট্রারকে ঘুষ দিয়েছি। এরপরও আমার রেজিস্ট্রির কাজটি আটকে রাখা হয়েছে। এত টাকা দেওয়ার পরও আরও টাকা চাইছেন তিনি।’
সদরের সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল বলেন, ‘আমাদের অফিসে কোনো সিন্ডিকেট নেই। নির্ধারিত ফির বাইরে কোনো বাড়তি টাকাও নেওয়া হয় না।
বরিশাল জেলা রেজিস্ট্রার মো: মোহছেন মিয়া নিজে ঘুষ সিন্ডিকেটে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘অফিসের কিছু কিছু লোক এ কাজে জড়িত থাকতে পারে। তবে আমি এর সাথে জড়িত নই। অহেতুক কেউ আপনাদের কান ভারি করেছে। তবে কেউ যদি ঘুষ সিন্ডিকেটে জড়িত থাকে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।