পিরোজপুর
আ’লীগের শাসনামলে সংখ্যালঘু নির্যাতন/ ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করে আজও দেশান্তরী প্রিয়া সাহা
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের কাছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিধনের ফিরিস্তি তুলে ধরে বেশ বিপাকে আছেন প্রিয়া সাহা নামের একজন হিন্দু নারী নেত্রী। ২০১৯ সালে ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে হোয়াইট হাউজে যোগ দেন তিনি। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাৎকালে প্রিয়া সাহা অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন। এ যাবৎকাল পর্যন্ত অসংখ্য হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ‘নিখোঁজ’ হয়েছেন, এমনও দাবি করেছিলেন বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহা। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ওই অভিযোগ সংবাদ আকারে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পরে বাংলাদেশে প্রিয়া সাহার শাস্তির দাবি নিয়ে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীরা। এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় মানবন্ধন কর্মসূচি পালন করাসহ পিরোজপুরে পিয়া সাহার গ্রামের বাড়িতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উৎপাত শুরু হয়ে যায়। ঘটনাপ্রবাহে প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে দুটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও করেছিল আওয়ামী লীগপন্থীরা। আদালত দুটি মামলা খারিজ করে দিলেও দেশে ফিরলে আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকদের হামলা-মামলা এবং জেল-জুলুমের শিকার হতে পারেন, এমন ভাবনায় তিনি আর প্রত্যাবর্তন হননি। চলতি বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই রাজনৈতিক দলটির শীর্ষ নেতাকর্মীরা জনরোষ থেকে বাঁচতে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান নিয়ে আছেন। এবং সংখ্যালঘু নির্যাতনের খোড়া অভিযোগ ক্রমাগতভাবে বিশ্বপরিমন্ডলে প্রতিষ্ঠিত করে বাংলাদেশে অশান্তির তৈরির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে হিন্দু নির্যাতন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করা সেই প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গ।
রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের অভিযোগ, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সবচে বেশি ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের শাসনামলে। হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের মানুষ সমান্তরাল আক্রান্ত হয়েছেন তাদের দখলবাজি-সন্ত্রাসে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতসহ আলেম সমাজকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর চালানো হয় স্টীমরোলার। দীর্ঘ আওয়ামী শাসনের প্রাক্কালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং তাদের গণমাধ্যম তৎসময়ে মুখে কুলুপ এটে ছিল। এমনকি হিন্দু নির্যাতন নিয়ে তখন ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করে আওয়ামী লীগের কবলে পড়া প্রিয়া সাহার স্বপক্ষেও কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বগ্রহণ করলে আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের রিপাবলিক বাংলাসহ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম। অভ্যুত্থান পরবর্তী নানা সংকটের মধ্যে ভারতে সংবাদমাধ্যমগুলো হিন্দু নির্যাতনের কথিত অভিযোগ বিশ্বমহলের নজরে এনে ফাঁয়দা লুটতে চাইছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নিয়ে তাদের তৈরি নানান গল্পকাহিনী ও উদ্ভট ব্যঙ্গাত্মক আচরণ সংবলিত সংবাদ প্রচার করতে দেখা যায়, যা বিস্ময়ের।
রাজনৈতিক বোদ্ধারা বলছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছর যে নির্যাতন নিপিড়ন চালিয়েছে, তা মানুষ আগামী ১০০ বছর মনে রাখবে। তাদের নির্যাতন থেকে বাদ যায়নি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ও, যার ফিরিস্তি ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ আকারে তুলে ধরেছিলেন হিন্দু নেত্রী পিরোজপুরের বাসিন্দা প্রিয়া সাহা। এতে আওয়ামী লীগ সরকার এবং দলটির নেতাকর্মীরা দেশের অভ্যন্তরে তুলকালাম পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। অভিযোগকারী প্রিয়া সাহার গ্রেপ্তার এবং শাস্তির দাবি করে মানববন্ধন করেও বিচার চাওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে আলোচিত প্রিয়া সাহা দেশান্তরী হয়ে আছেন। বাংলাদেশে প্রবেশ করলে আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা বা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কায় তিনি ভুগছেন। ফলে দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছেন।
সূত্র জানায়, তৎকালীন সময়ে ট্রাম্পের কাছে হিন্দু নির্যাতনের ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রিয়া সাহা সরকারের চক্ষুসূল হয়ে ওঠেন। এবং এই সুযোগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা পিরোজপুরের বানিয়ারি গ্রামে হিন্দু নেত্রীর বাসা-বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর করে। পাশাপাশি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি দখল নেওয়াসহ প্রিয়া সাহাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও রাখেন। রাজধানী ঢাকার বাসার সম্মুখেও তার শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ।
এবং আওয়ামী লীগ সরকার প্রিয়া সাহার অভিযোগের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছিল। প্রিয়া সাহার অভিযোগ ভয়ংকর মিথ্যা উল্লেখ করে তৎসময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে দেয়। যাতে বলা হয়, এসব সাজানো গল্পের পেছনে অশুভ উদ্দেশ রয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, এসব অভিযোগ কেন আনা হয়েছে, প্রিয়া সাহা দেশে ফিরলে তাকে এবিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, যা নিয়ে সরব হয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পদক ওবায়দুল কাদেরও। তিনি প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে ‘দেশদ্রোহী বক্তব্য দেবার’ অভিযোগ করে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের হুমকি দিয়েছিলেন।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ, সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগের চুলচেড়া বিশ্লেষণ করলে শেখ হাসিনা বা তার দল যে ধোঁয়াতুলসিপাতা নয়, স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অথচ ক্ষমতাচ্যুতির পরে সেই আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরতে চাইছে বিশ্বমহলে, যা হাস্যকর বলেও মন্তব্য পাওয়া যায়।