বরিশাল
বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ
শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়ছে হত্যা মাদক বিক্রিসহ অনৈতিক কর্মকান্ডে
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালের একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছিল বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ। অল্প দিনেই সুনাম ছড়িয়েছিল বিভাগ জুড়ে। কিন্তু একের পর এক কেলেংকারীতে স্কুলটির সুনাম আজ শুন্যের কোঠায়। প্রতিনিয়ত পত্র-পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষকরা যেমন বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে তাতে প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যত নিয়ে শংকিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। গত ২০ এপ্রিল সোমবার বেনাপোল সীমান্ত থেকে ৮২ বোতল ভারতীয় ফেন্সিডিল ও একটি মোটরসাইকেলসহ বরিশাল সরকারী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক নজরুল ইসলাম সুমন (৪৪) কে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। আটক শিক্ষক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বেনাপোল পোর্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিছুদিন আগে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপর এক শিক্ষক নারী হত্যার ঘটনায় আসামী হিসেবে জেল খেটে কারাগার থেকে সম্প্রতি জামিন পেয়েছেন। ঐ শিক্ষক এখন সাময়িক বরখাস্ত। গত দুই বছর আগে বাংলা দ্বিতীয়পত্রের শিক্ষক অরুন কান্তি ক্লাশ চলাকালে মো. নাহিয়ান ইসলাম নিলয় (১৪) নামে এক শিক্ষার্থীকে ডাস্টার ছুড়ে রক্তাক্ত করেছেন। অপরদিকে শিক্ষকদের গ্রুপিংয়ের কারনে স্কুলটিতে লেখাপড়া মান এখন নিম্নমুখী। যা গত বছরের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলই তার প্রমান। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে তিনটি গ্রুপ। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে গনিতের শিক্ষক আবু মামুন। এ গ্রুপে রয়েছেন মাজেদা, হুমায়ুন কবির, মাসুম বিল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, মোস্তফা কামাল, ওয়াহিদুজ্জামান, মাজহারুল ইসলাম, রাজিব, হুমায়ুন, পলাশ কুমার, রনজিৎ সাহা, শিখা রানী ও অনামিকা। দ্বিতীয় গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে এস এম মাইনুদ্দিন। এ গ্রুপে রয়েছেন অলোক কুমার সরকার, এম সাজ্জাতুল ইসলাম, মোঃ জাহাদ হোসেন (যুক্তিবিদ্যা), মোঃ জাহিদুল ইসলাম (ইংরেজী), মুহাম্মদ রেজাউল করিম খান, কাজী আসিফ মাহমুদ হোসেন, এইচ এম শাহজালাল, সুশান্ত অধিকারী, ফারজানা আক্কার ঝুমা, অসীমা বেপারী, মোঃ শাজাহান ও অরিন্দম চৌধুরী। তৃতীয় গ্রুপ স্বপন কুমার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গৌরী প্রসাদ রায়, নুর উদ্দিন, সমীর কুমার বিশ্বাষ ও মোহিব্বুল্লাহ মুহিব। ত্রিমুখী গ্রুপিংয়ের ফলে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের চেইন্ড অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। কেউ শুনেনা কারো কথা। শিক্ষকরা ক্ষমতার দ্বন্ধে জড়ানোর ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার পরিবেশ নেই। অর্থ আত্মসাৎ, কোচিং বানিজ্য, ক্ষমতা আর স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম গ্রুপিংয়ের কারনে প্রায়ই হট্টোগোল হয় প্রতিষ্ঠানটিতে। সরকারি গেজেট অমান্য করে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজে এক্সট্রা ক্লাশের নামে কোচিং পড়ানো হচ্ছে প্রতি বিষয়ে পাচঁশত টাকা নিয়ে। এ টাকা সরাসরি নেয়া হয় কোন রশিদ ছাড়াই। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বানিজ্য বন্ধ নীতিমালা ২০১২ গেজেট আকারে ২০১৯ সালের ২৪ জানুয়ারী প্রকাশিত হলেও মানা হচ্ছে নীতিমালা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক জানান, বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজ নামে মডেল। এখানে কোন লেখাপড়া নেই। এ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের তিনটি গ্রুপ। সারাদিন গ্রুপিং নিয়ে শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন কারনে বছরে প্রায় ২৪৫ দিনই বন্ধ থাকে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষকরা নিজেরাই ছাত্র-ছাত্রীদের কোচিংমুখী করে তুলছেন। ক্লাস শিক্ষকের কাছে কোচিং না করলে পরীক্ষার ফলাফলে বাচ্চাদের নম্বর কম দেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই বেশির ভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের কোচিং এ পড়াচ্ছেন। এখানের শিক্ষকদের আচরণ এখন আর প্রকৃত শিক্ষকদের মতো নেই। বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজে চাকরি করা বেশির ভাগ শিক্ষক এখন কোচিং ব্যবসা খুলে বসেছেন প্রতিষ্ঠানটির অভ্যান্তরেই। যেখানে বেতন বাদ দিয়েও শিক্ষকরা প্রতিমাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন। এ বিষয়ে কোনো অভিভাবক প্রতিবাদ করলে তাদের সন্তানদের ভিন্ন চোখে দেখেন শিক্ষকরা। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(শিক্ষা ও আইসিটি) প্রশান্ত কুমার দাস বলেন, মডেল কলেজের সভাপতি বিভাগীয় কমিশনার স্যারের সাথে পরে এ ব্যাপারে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে কলেজের পরিস্থিতি নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। তবে দেশের এই সংকট মুহূর্তে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অন্য যে কোন ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। অপরদিকে কলেজটির অধ্যক্ষ হাজার হাজার টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড করেছেন টেন্ডার ও একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ছাড়াই। অথচ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ঘোষনার ফলে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য আর্থিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রনালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। অনুমোদন না নিয়েই প্রতিষ্ঠানটির সংস্করন কাজসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। শুধু তাই নয়, মাসের অর্ধেক সময় ঢাকা থাকেন অধ্যক্ষ। করোনার এই দুঃসময়েও তিনি বরিশালে নেই। ঢাকায় থাকার কারনে গত ১০ এপ্রিল বেতন দেয়া হয় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। বর্তমানে করোনার এই দুর্যোগে শিক্ষার্থীদের কোন নির্দেশনা না দেয়ায় অভিভাবকরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে জানা গেছে অধ্যক্ষ বর্তমানে ঢাকা রয়েছেন। কলেজের টেলিফোনে একাধিকবার কল করা হলেও কেউ রিসিভ করেনি। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশের ১২টি কলেজের মধ্যে বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজটিকেও সরকারি করন করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে ১২টি কলেজকে সরকারিকরন করা হয়। যার মধ্যে বরিশাল বিভাগে শুধুমাত্র বরিশাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজকে সরকারিকরন করা হয়।