বরিশাল
প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন সব হারের পেছনেই কাজ করেছে আবুল হাসানাত আব্দুল্লার চোখের ইশারা
হাসানাত-সাদিক মাঠে না নামলেই খোকনের জন্য আশীর্বাদ
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ প্রায় দুই যুগের বেশী বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অনুসারীরা দলীয় যে প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন নির্বাচনে ওই প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। আসন্ন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে হাসানাত পরিবার মাঠে নামলে পরাজয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কায় রয়েছেন এখানকার নেতাকর্মীরা।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের পঞ্চম পরিষদের নির্বাচনে মেয়র পদে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়ার পর ভোটের মাঠে চলছে নানা হিসেব নিকেশ। বিশেষ করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে মাঠে নামেননি। তাদের এই মাঠে না নামার বিষয়টিকে ভোটের রাজনীতিতে কেউ বলছেন ইতিবাচক আবার কেউ বলছেন নেতিবাচক।
তবে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ না করাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর জন্য আশীর্বাদ। তাদের দাবী যেই সব নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অনুসারীরা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন সেই নির্বাচনেই পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। বরিশাল সদরে বার বারই আওয়ামী লীগের এই হারের পেছনে ঐতিহাসিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমিন উদ্দীন মোহন।
তিনি বলছেন, নিজের আখের গোছাতে ১৯৯১ সাল থেকে নিজ দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূচনা করেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। সাবেক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমানকে বরিশাল সদর আসনে সুযোগ করে নিজে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন আগৈলঝাড়া থেকে। ওই নির্বাচনে সদর আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ বীর বিক্রম। মোহনের দাবী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ কৌশল করে নির্বাচনে ভেতরে ভেতরে রহমান বিশ্বাসের পক্ষে কাজ করেণ। একইভাবে ১৯৯৬ সালেও সদর আসে বিএনপি প্রার্থীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজয় বরণ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাহাবুব উদ্দীন আহমেদ বীর বিক্রম। এর আগে ১৯৯১ সালের উপ নির্বাচনে সার্জেন্ট ফজলুল হককে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হলে তার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। ১৯৯৮ সাবেক এমপি নাসিম বিশ্বাসের মৃত্যু হলে সদর আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদকে। তিনিও পরাজিত হন বিপুল ভোটে। একইভাবে ২০০১ সালে শওকত হোসেন দলীয় মনোনয়ন পেলেও বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। সব নির্বাচনেই উপরে উপরে সরব উপস্থিতি ছিলো আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর।
প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন সব হারের পেছনেই কাজ করেছে আবুল হাসানাত আব্দুল্লার চোখের ইশারা। শুধু সংসদ নির্বাচন নয় পৌর এবং সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও যতবার মাঠে নেমে কাজ করেছেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা ততবারই হেরেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ২০১৩ সালের বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণ। আর বিএনপির প্রার্থী ছিলেন প্রয়াত আহসান হাবীব কামাল। নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর লোকজন বিএনপির প্রার্থী আহসান হাবীব কামালের আনারস প্রতীকের পক্ষে কাজ করেণ। হাসানাত ঘরানার আওয়ামী লীগ নেতা মিলন ভূঁইয়াকে আনারস প্রতীকের লিফলেটসহ হাতেনাতে ধরা হয়। এর আওয়ামী লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সৈয়দ আনিচের বাসায় গিয়ে জরুরী বৈঠক করেণ। আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর লোকজন যাতে বিরোধীতা না করে এ জন্য আনিসের মাধ্যমে অনেক অনুরোধও করা হয়েছিলো তৎকালীন সময়ে। অনেক জনপ্রিয় ব্যক্তি হওয়ার পরেও কেবল আবুল হাসানাতের ষড়যন্ত্রে কারণে ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে শেষ পর্যন্ত হেরে যান শওকত হোসেন হিরণ।
অথচ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ পরিবার মাঠে না থাকায় প্রথমবারের মত মেয়র নির্বাচিত হয়ে বিএনপির দুর্গে আঘাত হেনেছিলেন হিরণ। পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৩ সালে। ওই নির্বাচনে নাগরিক ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া প্রয়াত এনায়েত পীর খানকে। নির্বাচনে তার পক্ষে প্রকাশ্যে মাঠে করেছেন আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা। কিন্তু তারপরেও বিপুল ভোটে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে এনায়েত পীরকে। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। নির্বাচনে মাঠে ভূমিকা নিয়ে তার সাথে একটি সমাবেশ মঞ্চে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী সাহানারা বেগমের মধ্যে বাগবিতন্ডা হয়। এর আগে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিলো ১৯৯৫ সালের পৌর নির্বাচনে। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সৈয়দ গোলাম মাহাবুব এবং বিএনপির প্রার্থী ছিলেন আহসান হাবীব কামাল। কিন্তু আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর কৌশলের কারণে কামালের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন মাহাবুব।
আসন্ন পঞ্চম পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে। যিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই। মনোনয়ন থেকে ছিটকে পড়েছেন বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। যিনি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বড় ছেলে। বাবা হাসানাত চেয়েছিলেন এবারও তার ছেলেকে মনোনয়ন দেয়া হোক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার কথা না শোনায় অনেকটা নাখোশ তিনি। এ কারণে বাবা-ছেলে কেউ এখনো প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেননি। দলীয় একাধিক সূত্র বলছে আসন্ন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে হাসানাত পরিবারের অংশগ্রহণ ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক ভূমিকাই বেশি রাখবে।
এ প্রসঙ্গে শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর আমির উদ্দীন মোহন আবুল হাসানাত পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তারা কার রাজনীতি করে আমরা বুঝিনা। যেখানে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী প্রার্থী দিয়েছেন সেখানে তারা এখনো নিশ্চুপ। প্রধানমন্ত্রী না বললে তারা মাঠে নামবেন না। এটা কেমন রাজনীতি। মোহনের আশঙ্কা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারীরা নির্বাচনে নামলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহর পরাজয় নিশ্চিত। তিনি অভিযোগ করে বলেন, হাসানাত আব্দুল্লাহর চোখের গভীরতা বড়ই নিষ্ঠুর। নিজেকে ছাড়া কিছুই বোঝেন না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের মায়ের মিলাদের পর্যন্ত তিনি তোকর্মীদের যেতে নিষেধ করেন। এর চেয়ে খারাপ রাজনীতি আর কি হতে পারে।