বরিশাল
প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় সাদিক, বিসিসি’র দাপ্তরিক কাজে স্থবিরতা
আড়ালে থেকেই চাচা’র বিরোধিতা
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সিটি করপোরেশনের (বিসিসি) মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় পর থেকেই নগর জুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে তাকে নিয়ে। যা বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করছে। অনেকটা নড়বড় হয়ে পড়েছে নিজের হাতে তিলতিল করে গড়ে ওঠা হীরক রাজার সাম্রাজ্য। তাই দলের কাছে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অনেকটা অনুপায় হয়েই নৌকার মনোনীত প্রার্থী চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে কাজ করার আহবান জানিয়েছেন বিভিন্ন সংগঠন ও তার অনুসারীদের। তবে নির্বাচনে নৌকা প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার আহবান জানালেও তার অনুগত কর্মীবাহিনীরা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে কোন প্রচারণায় নেই। মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ার পর দুই-তিনবার ভার্চুয়ার্লি নেতাকর্মীদের এমন নির্দেশনা দিলেও বাস্তবে তেমন কোন সাড়া দিচ্ছে না তার অনুসারীরা। তবে বিষয়টি বিষয়টি দলের জন্য ‘অশনি সংকেত’ হিসেবে দেখছেন মাঠপর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা।
তারা মনে করছেন, যদি খোকন সেরনিয়াবাত এখানে মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন তাহলে বরিশালে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ পরিবারের অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটবে। এটি তারা চান না এবং এ কারণেই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নয় বরং খোকন সেরনিয়াবাতকে হারানোই তাদের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাচন যতই এগোতে থাকবে ততই সাদিক আব্দুল্লাহর আসল রূপ প্রকাশিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সহজ-সরল রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশে হাসনাত পরিবার খোকন সেরনিয়াবাতের বিরোধিতা করছে। অন্যদিকে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু সাদিক আব্দুল্লাহ এ বিষয়টিও মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া নগরে পাঁচ বছর ধরে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর প্রচার-প্রচারণায় ছিল একক নিয়ন্ত্রণ। তবে কেউই এ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে পারেননি। আর এখন সেই নিয়ন্ত্রন তার চাচা খোকন সেরনিয়াবাতের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। তাই অনেকটা প্রকাশ্যে চাচার বিরোধিতা না করলেও তার অনুগত কর্মীবাহিনীরা খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে কোন প্রচারণায় নেই।
এমনকি বিগত এক মাসের বেশী সময় ধরে সাদিক আব্দুল্লাহ ঢাকায় অবস্থান করছেন। তিনি কবে ফিরবেন তা কেউ বলতে পারছেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের তথ্যমতে, মনোনয়ন হারানোর পর দলের শীর্ষ পর্যায়ে এক ধরনের বোঝাপড়া করতে চান তিনি। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের অপেক্ষায় রয়েছেন। এদিকে তিনি ঢাকায় বসেই করপোরেশনের কাজকর্ম সারছেন। কিন্তু মেয়র সাদিকের নগরে অনুপস্থিতির সুযোগে নগরে নানা অনিয়ম জেঁকে বসেছে। নগর ভবনের কাজকর্মে মন্থরগতি দেখা দিয়েছে। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ মানুষ। গলিপথগুলোর অবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে নগরের পাঁচটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
জানতে চাইলে বিসিসির প্যানেল মেয়র গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, মেয়র সাদিক গত ৪ এপ্রিল ঢাকায় যান। এরপর থেকে রাজধানীতেই আছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি বরিশালে ফিরবেন। প্যানেল মেয়র আরও বলেন, মেয়র না থাকায় নগরভবনে ঢিলেঢালা ভাব থাকতে পারে। তবে সেকশনগুলোতে স্টাফরা যার যার ফিল্ড ওয়ার্কে চলে যান। নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র করপোরেশন পরিচালনা করবে, তাই বন্ধ আছে। তিনি আরও বলেন, নতুন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগেই অনিয়ম শুরু হয়ে গেছে। মেয়রের ফেরা নিয়ে সমর্থকেরা চিন্তা করতেই পারে। কেউ কেউ মনে করছেন, মেয়র সাদিক আর বরিশালে আসবেন না। আসলে মেয়র ফিরে এলে সব কিছু আগের মতো হয়ে যাবে।
তবে সিটি করপোরেশনের হোল্ডিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বরিশালের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান বলেন, মেয়র কেন এক মাস এলাকায় নাই। এটাও তো কর্তব্যে অবহেলা। তিনি অনুপস্থিত থাকায় সেবা ব্যাহত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, নগর চলে জনগণের টাকায়। অথচ সিটি করপোরেশন পানি, হোল্ডিং, সাইনবোর্ডের মোটা অঙ্কের ট্যাক্স নিয়ে জনগণকে চাকর বানিয়ে রেখেছে। আগামী দিনে নগরবাসী কতটা সেবা পাবে, তা জানতে মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে সংলাপ করা হবে।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশালের সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, মেয়র দীর্ঘ সময় নগরের বাইরে থাকায় নাগরিক সেবা অনেকটাই মন্থর গতিতে চলছে। এলাকায় মশার যন্ত্রণায় থাকা যায় না। অলিগলির রাস্তা বেহাল। এই বর্ষায় রাস্তা ও ড্রেন সংস্কার না হলে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। অথচ তিনি সাতটি খাল খনন করতে দেননি। এ বিষয়ে জানতে বিসিসি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বিসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. ফারুক হোসেনকে ফোন দেয়া হলে তিনি রিসিভ করেননি।
তবে সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস বলেন, মেয়র কবে নাগাদ বরিশালে ফিরবেন তা জানা নেই। তিনি ঢাকায় আছেন। এক মাসের বেশি সময় ধরে নগরের বাইরে থেকে দাপ্তরিক কাজ কীভাবে চালাচ্ছেন জানতে চাইলে স্বপন বলেন, তিনি ভার্চুয়ালি কিছু কাজ করছেন।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশালের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, গত সাড়ে চার বছরই মেয়র সাদিকের জনসম্পৃক্ততা ছিল না। এখন মনোনয়ন হারিয়ে এক মাস ধরে ঢাকায় আছেন। ঢাকায় বসে কি করপোরেশন চালানো সম্ভব? এতে যে নগরভবনের কাজকর্ম এবং নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়, তা কে বুঝবে। এ রকম চললে স্থবির হয়ে পড়বে বরিশাল নগরী।
উল্লেখ্য, বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ২০১৮ সালে নির্বাচিত হয়ে বিগত ৫ বছরে নগরীর কোনো উন্নয়ন করতে পারেনি। বিপরীতে আধিপত্য বিস্তার, প্রশাসনের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী নির্যাতন, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকুরিচ্যুত এবং বছরের পর বছর ধরে ওএসডি, ট্যাক্স বাড়ানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে সাদিকের বিরুদ্ধে। ধারণা করা হচ্ছে এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়ে সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে এবারের নির্বাচনে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে মনোনয়ন দিয়েছে।