বরিশাল
অনিয়মিত থেকেও উচ্চতর বেতন স্কেল (৮ম গ্রেড) প্রাপ্তির জন্য প্রধান শিক্ষককে চাপ প্রয়োগ
পনেরো বছর স্কুলে আসেন না উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রেহানা
এস এন পলাশ ॥ বরিশাল সদর উপজেলার তিনবারের ভাইস চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেত্রী রেহানা বেগম। এই জনপ্রতিনিধি আবার একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকও। সরকারি বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে একই সময়ে দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বেতন ভাতা উত্তোলন করায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। দীর্ঘ পনের বছর বিদ্যালয়ে অনিয়মিত থাকার পরও চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল ২য় উচ্চতর বেতন স্কেল (৮ম গ্রেড) প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধান শিক্ষক বরাবর একটি আবেদন করেন। তার এই অনিয়মের প্রতিবাদ করায় হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তবুও বহাল তবিয়তে আছেন এই আওয়ামীলীগ নেত্রী।
সূত্র মতে, সদর উপজেলার চরবাড়িয়া ইউনিয়নের কাগাশুরা মাধমিক বিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের সহকারী শিক্ষক রেহানা বেগম। যার ইনডেক্স নম্বর-৫১৯১৪৫। নিজের বাড়ির পাশেই কাগাশুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রভাব খাটিয়ে ২০০২ সালে আইসিটি বিভাগের সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেন। তিনি এখনও ওই বিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের সহকারী শিক্ষক পদে বহাল আছেন। যার প্রমাণ গত মাসের ২৯ এপ্রিল বেতন স্কেল বাড়ানোর জন্য তার স্বাক্ষরিত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বরাবর আবেদন পত্র।
সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি ২০০২ সাল থেকে বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। চাকুরীর বয়স ১৬ বছরের অধিক হওয়ায় ২য় উচ্চতর বেতন স্কেল (৮ম গ্রেড) প্রাপ্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানানো হয়েছে। এদিকে ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে ২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এক বছরের জন্য পদত্যাগ করেছিলেন রেহেনা বেগম। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধি মোতাবেক, কোনো শিক্ষক বা কর্মচারী একই ব্যক্তি একাধিক পদে চাকরি বা আর্থিক লাভজনক কোনো পদে নিয়োজিত থাকতে পারবেনা। তাই (২০০৮ সালের ১৭ নভেম্বর) তিনি স্কুলে লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। তার পদত্যাগপত্রটি ২০০৯ সালের ২৪ জানুয়ারি বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির পূর্ণাঙ্গ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়, পদত্যাগকৃত পদটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ওই নির্বাচনে জয় পেয়ে নারী ভাইস চেয়ারম্যান হন তিনি।
এরপর বিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের সহকারী শিক্ষকের পদত্যাগকৃত পদটিতে বিধি মোতাবেক পূর্ণবহল না হয়েই ২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ২৭ জুলাই ২০১১ পর্যন্ত দুই বছর আট মাসের জন্য বিনা বেতনে ছুটিতে থাকেন রেহেনা। ছুটি মঞ্জুর সাপেক্ষে বিদ্যালয়টি থেকে ২ লাখ লক্ষাধিক টাকাও উত্তোলন করেন। একই সময়ে তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদের সরকারি ভাতাও গ্রহণ করেন। পরে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের উপজেলা নির্বাচনেও একই পদে নির্বাচিত হন রেহানা বেগম।
তবে সেই সময়ে ছুটি মঞ্জুর না করিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ২০১১ সালের ২৮ জুলাই বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক পদে নিয়মিত বহাল থাকেন। এরপর দশ বছর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে থেকে রাষ্ট্রের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোরপূর্বক হাজিরা খাতায় সই করে প্রধান শিক্ষককে চাপ প্রয়োগ করে বেতন তুলছেন নিয়মিত। ওই সময়ে বিদ্যালয়ের সরকারি ও বেসরকারি বেতন ভাতা বাবদ ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ১৭৩ টাকা উত্তোলন করেন। একই সঙ্গে উপজেলা পরিষদের রাজস্ব তহবিল থেকে ২০১১-২০১৯ পর্যন্ত ১৯ লাখ ২০ হাজার ৪৬৮ টাকা উত্তোলন করে আত্মাসাৎ করেন।
উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (৩০ জুন ২০০৯ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুসারে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে আইনত কোনো বাধা নেই। তবে এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৫-০১-১৯৮৬ তারিখে জারিকৃত নির্দেশনা মানতে হবে। সেই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা অন্য কোনো শিক্ষক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হইলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাকরি হইতে পদত্যাগ না করিয়া সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের নিকট থেকে বিনা বেতনে ছুটি মঞ্জুর সাপেক্ষে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বহাল থাকতে পারবেন। এই নির্দেশনাটি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের বেলায়ও প্রযোজ্য হইবে। তবে সরকারের এমন নির্দেশনা থাকলেও মানেননি মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রেহেনা বেগম।
তার এমন ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন কাগাশুরা মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম। এজন্য তাকে একাধিকবার লাঞ্ছিত করেছেন রেহানা বেগমের বাহিনী। হয়েছেন হামলা-মামলার শিকার। এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি ২০১১ সালে এই স্কুলে যোগদানের পর থেকেই দেখছি রেহেনা বেগম মাসে দুই একদিন স্কুলে আসেন। মাঝে মাঝে পুরো মাস জুড়েই স্কুলে অনুপস্থিত থাকেন। হাজিরা খাতায় পুরো একমাসের সই একদিনে করতেন। তবে প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন নিতেন। এ নিয়ে প্রথমে মৌখিকভাবে তাকে বললে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দেয় রেহানা বেগম ও তার বাহিনী। এরপরে স্কুল চলাকালীন সময়ে দলবল নিয়ে আমাকে মারধর করেন, যাতে করে তার এই অনিয়ম আমি মেনে নেই। সর্বশেষ আমার নামে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। তবে ধোপে টেকেনি আমার বিরুদ্ধে দেয়া ষড়যন্ত্রমূলক সকল মামলা।
প্রধান শিক্ষক বলেন, আমাদের স্কুলে এমপিও ভুক্ত শিক্ষক দশজন, তার ভিতরে রেহেনা বেগমও একজন। টানা পনেরো বছর যাবত তার ক্লাস অন্য শিক্ষককে দিয়ে করানো হচ্ছে। নয় জন শিক্ষক দিয়ে স্কুলের ক্লাশ পরিচালনা করিয়ে বেতনের সিটে দশজনের সই করতে হচ্ছে আমাকে। অনেকটা ক্ষোভের সাথে তিনি আরো বলেন, অপরদিকে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদেও বহাল তিনি। একাই দুটি পদ দখল করে বসে আছে। এমনকি কোনো মন্ত্রণালয়ও বেতন-ভাতা তোলার জন্য অনুমোদন দেয়নি। শুধু মাত্র দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বেতন-ভাতা তুলছেন তিনি। তার এই অনিয়মের বিরুদ্ধে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার লিখিত জানানো হলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, রেহেনা বেগম এর আগে উপজেলা থেকে সম্মানী নিলেও গত দুই-তিন বছর যাবত কোন ভাতা নিচ্ছেন না। তবে কি কারণে নিচ্ছেন না তার জবাব দিতে বললেও তিনি কোনো জবাব দিচ্ছেন না। তবে দুদক তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা শুরু করলে তিনি গত কয়েক বছর যাবৎ উপজেলা পরিষদ থেকে ভাতা উত্তালন করা থেকে বিরত রয়েছেন। এছাড়াও রেহেনার বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে, অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত চলমান আছে।
কাগাশুরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও বরিশাল সদর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রেহেনা বেগম বলেন, আমি একা নয় এরকম অনেকই আছেন। জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষকতা এক সাথে করছেন। আমিও করি, এখানে দোষের কিছু নেই।