বরিশাল
দক্ষিণাঞ্চলের অসাধু চিকিৎসকদের কাছে জিম্মি রোগীরা
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ রোগীরা সরকারি হাসপাতালের কতিপয় অসাধু চিকিৎসক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ও দালালের হাতে জিম্মি হয়ে পরেছেন। জেলা ও উপজেলার প্রতিটি সরকারি হাসপাতালকে ঘিরে এসব দালাল চক্রটি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে।
অসাধু চিকিৎসকদের তালিকায় রয়েছেন জেলা ও উপজেলার অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালের কতিপয় চিকিৎসক। মোটা অঙ্কের টাকা কমিশনের আশায় ওইসব চিকিৎসক সাধারণ রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নামসর্বস্ব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে থাকেন। এ কমিশন বাণিজ্য নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র শেবাচিম হাসপাতালে টানা তিনদিন কর্মবিরতি পালন করেছেন ইন্টার্ন চিকিৎসকেরা।
জানা যায়, বরিশাল নগরীতে আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসাসেবা নিতে আসা গ্রামের সহজ-সরল মানুষ প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন রোগী ধরা দালালদের হাতে। বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত সত্য হলেও নিত্যদিনের এ জঘন্য অপকর্ম বন্ধের কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। ফলে কতিপয় অসাধু ডাক্তার, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক এবং দালাল চক্রের কালো থাবা ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। যার ফলে আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়েও কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। পাশাপাশি নামসর্বস্ব ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ছে নবজাতকসহ প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুর সংখ্যা। এসব মৃত্যুর ঘটনায় মাঝে মধ্যে থানায় মামলা দায়ের করা হলেও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে মামলাগুলো আর আলোর মুখ দেখে না।
বরিশালে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের ছড়াছড়ি বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশাল নগরীসহ প্রতিটি উপজেলা সদরের অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে নামসর্বস্ব অসংখ্য ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও অনুমোদনহীন ক্লিনিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে গড়ে ওঠা অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি। এমনকি দক্ষ জনবলও নেই। ফলে একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর পর একেক ধরনের রিপোর্ট পাওয়া যায়। এমনকি এক ব্যক্তির রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ে দুটিস্থানে দুই ধরনের গ্রুপের কথা বলা হয়।
বিষয়গুলো জানার পরেও মোটা অঙ্কের টাকা কমিশনের জন্য সরকারি হাসপাতালের নামকরা কতিপয় অসাধু চিকিৎসকরা ওইসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠিয়ে থাকেন। যে কারণে নামসর্বস্ব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে প্রতিনিয়ত রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, ওইসব চিকিৎসকদের পাঠানো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো না হলে রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয় না। বরিশালের প্রেক্ষাপটে কতিপয় চিকিৎসক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের এই রক্তচোষার বিষয়টি সম্পর্কে প্রশাসন ওয়াকিবহাল থাকলেও স্থায়ীভাবে তা প্রতিরোধে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতার কারণে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসা সেবা প্রত্যাশীরা অর্থ হারিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কখনো কখনো রোগীসহ স্বজনরা ডায়াগনস্টিক মালিক ও তাদের ভাড়াটিয়া মাস্তানদের রোষানলে পরে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া, প্রায় প্রতিটি বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে স্ব স্ব এলাকার ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা জড়িত থাকায় প্রশাসনও বিষয়টি এড়িয়ে চলেন। যে কারণে নামসর্বস্ত্র বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এদিকে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার মধ্যে বরিশাল ব্যতীত ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব প্রকট। এ কারণে বরিশালসহ অপর পাঁচ জেলা শহর, উপজেলাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিরীহ ও সাধারণ মানুষ প্রতিদিন আসেন বরিশাল নগরীতে ভালো চিকিৎসক থেকে আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিতে। এসব মানুষেরই একটি বড় অংশ দালাল চক্রের খপ্পরে পরে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করেন। কিন্তু তারা ভালো চিকিৎসক তো দূরের কথা সঠিক চিকিৎসকের নাগালও পাচ্ছেন না।
নগরীতে প্রবেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট এবং ডাক্তার চেম্বার এলাকাগুলো ঘিরে থাকে দালাল চক্রের সদস্যরা। নগরীর একতলা লঞ্চঘাট, নথুল্লাবাদ ও রূপাতলী বাস টার্মিনাল, শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং আধুনিক সদর হাসপাতালের সামনে প্রতিদিন তৎপর থাকে কমপক্ষে শতাধিক রোগী ধরা দালাল। সূর্যোদয় থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দালাল চক্রের সদস্যরা ওইসব স্থানগুলোতে ওঁৎ পেতে থাকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা সহজ-সরল রোগীদের ধরার জন্য।
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে ওই সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে টেকনিশিয়ান দাবি করা রফিকুল ইসলাম জানান, বরিশালের ২-১টি বাদে কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারেই প্যাথলজিস্ট নেই। যারা কাজ করছেন তাদের অধিকাংশই তার মতো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কর্মরত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোতে রোগীরা আসতে না চাইলেও দালালদের কাজ তাদের (রোগী) ফাঁদে ফেলে নিয়ে আসা। আর চিকিৎসকরা বেশি কমিশন পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়তা নেই এবং রোগ একটি কিন্তু তারপরেও অন্য রোগের পরীক্ষা দিচ্ছেন। এমনি করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে রোগীদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ রোগীরা কাঙ্খিত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বরিশাল, চরমোনাই, চরকাউয়া, চরবাড়িয়া, কাশিপুর, সায়েস্তাবাদ, গ্রাম্য অনেক চিকিৎসক নিজের নামের পাশে স্পর্শকাতর বিভিন্ন রোগের অভিজ্ঞতার সাইনবোর্ড লাগিয়েছেন। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা দেয়ার নামে নিজের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষার নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন জানা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে এসব ভুয়া চিকিৎসাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বেসরকারি সকল অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের তথ্য দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওই তালিকা ধরে খুব শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে।