বরিশাল সদর
আইনি জটিলতায় চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে চোখের আলো
হাসপাতালে অবরুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তানভীর
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আহসান (বীর প্রতীক)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই সাহসীযোদ্ধা মায়ের অনুপ্রেরণায় বন্দুক হাতে তুলে যুদ্ধে যোগ দেন। তারই ছোট ছেলে তানভীর আহসান। নগরীর ১৬নং ওয়ার্ড আ’লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক। বরিশাল আ’লীগের রাজপথের একজন লড়াকু সৈনিক। আ’লীগের প্রতিটি কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে কর্মীদের নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি।
গত ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ কম্পাউন্ডে ব্যানার অপসারণ করতে গেলে ইউএনওর নিরাপত্তায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের ছোড়া গুলিতে চোখ হারায় বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান তানভীর। ওই রাতে তার শরীরে ৫০টি ও চোখে ৫টি গুলির স্পিলিন্টার লাগে। চেখের পাশের একটি গুলি বের করা হলেও বাকি চারটি এখনও ভেতরে রয়েছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে ২০টি গুলি বের করা হলেও এখনও বুকের ভিতর ২টি, পায়ের বিভিন্ন অংশে ১৫টি এবং পিঠে ১৩টি গুলির স্পিলিন্টার রয়ে গেছে।
বাম চোখটি কোনোভাবে রক্ষা হলেও ডান চোখে সে দেখছে না। কারণ সেখান থেকে গুলি বের করা যায়নি। আর চিকিৎসকরা বলছে, এটি বের করতে গেলে তার মস্তিস্কে সমস্যা হতে পারে এবং অপর চোখটিও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা তানভীরকে বিদেশে নিয়ে যেতে বললেও আইনি জটিতলার কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে তার পরিবার। রাজধানীর আগারগাঁও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয় তলার ৬০৭ নম্বর কেবিনে পুলিশ পাহারায় চলছে তার চিকিৎসা।
আদরের ছোট ভাইয়ের এমন করুণ অবস্থা দেখে প্রতিনিয়ত ভেঙে পড়ছেন তানভীরের বড় ভাই তানজিল আহসান। তিনি বলেন, একদিকে ভাইয়ের চোখ নিয়ে উদ্বিগ্ন, অন্যদিকে পুলিশি ঝামেলা। সারাক্ষণ হাসপাতালের রুমের দরজা তালা মেরে রাখে। চিকিৎসার জন্য কোথাও যেতে হলে পুলিশ ডেকে তালা খুলতে হয়। এসময় ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা কি এই অসুস্থ রোগী নিয়ে পালিয়ে যাব? সারাক্ষণ আমাদের নজরদারিতে রেখেছে। আমরা কি জামাত বিএনপি নাকি হত্যা মামলার আসামী।
অপরদিকে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে হবে, তবে সেখানেও যে ভালো হবে তার সম্ভবনা কম। তবে উন্নত চিকিৎসা হলে অপর চোখটি ভাল থাকবে।
এদিকে আহত তানভীর আহসান বলেন, দুর্ঘটনার পর দু’দিন চোখে আবছা আবছা দেখতে পেতাম কিন্তু এখন ডান চোখে কিছুই দেখতে পাই না। চোখের সাথে সাথে আমার ভবিষ্যতও অন্ধকার হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমার হার্টে রিং পড়ানো তাই ডাক্তাররা ঝুঁকি নিয়ে চোখের অপারেশন করাননি। তারা বলেছেন বাংলাদেশে এই অপারেশন করা সম্ভব নয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিদেশে যেতে হবে। দেরি হলে অপর চোখটি নষ্ট হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি আরো বলেন, বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা করার সামর্থ্য আমার নেই। ছোট বেলায়ই বাবাকে হারিয়েছি। মা অনেক কষ্ট করে আমাদের দুই ভাইকে মানুষ করেছেন। আমাদের এমন কোন অর্থ সম্পদ নেই, যা দিয়ে বাহিরে ভালো কোন চিকিৎসা নিব। নিজের তিন মাসের একটি সন্তান রয়েছে, পরিবার ও ভবিষ্যত নিয়ে আমি চিন্তিত। তবে মেয়র সবসময় আমার খোঁজ খবর নিচ্ছেন। আশ্বাস দিয়েছেন প্রশাসনিক ঝামেলা শেষ হলে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। আমি তার আশ্বাসে আস্থা রাখছি। তিনি ছাড়া আমাকে সহযোগিতা করার আর কেউ নেই।
এ বিষয়ে বরিশাল জেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. তালুকদার মোহাম্মদ ইউনুছ বলেন, তানভীর বর্তমানে ঢাকায় আটকাবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। তবে তাকে বরিশালে আনার প্রস্তুতি চলছে। এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনার মোঃ শাহাবুদ্দিন খান বলেন, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা করালে পুলিশ কোন বাঁধা দেবে না। তবে আদালতের নির্দেশের বাহিরে পুলিশ কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, চার্জশিটভুক্ত আসামীরা আগাম জামিন নিতে পারেন। তিনি বাহিরে গিয়ে চিকিৎসা করাতে চাইলে আদালতের অনুমতি নিয়ে যেতে পারেন।
তানভীরের মা মহাসিনা পারভীন বলেন, সারা শরীরে ৫০টির মতো গুলির স্পিলিন্টার রয়েছে। আমি ছেলের চোখ ভালো হয়ে যাক সে কামনা করছি। চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী দেশে এর থেকে ভালো আর কিছু করা সম্ভব নয়, তাই বিদেশে নিয়ে হলেও চিকিৎসা হোক। তিনি বলেন, সিটি মেয়র প্রতিনিয়ত আমাদের খোঁজ রাখছেন, তিনি আশ্বস্ত করেছেন দেশের বাইরে নিয়ে হলেও তানভীরের চোখের চিকিৎসা করাবেন। স্বাধীন দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের গায়ে সরাসরি গুলি ছোড়ার ঘটনা দেশবাসীকে বিস্মিত করেছে। আমি এর দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবী জানাই।