বরিশাল
বরিশাল শের-ই-বাংলা কলেজ হাসপাতালে তুখোর প্রতারক শাহেদ রূপে তাজুল
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ স্বাস্থ্য বিভাগের তুখোর প্রতারক শাহেদ রুপে আউট সোর্সিং কর্মচারী তাজুলকে রুখবে কে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে। দখিন জনপদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাস্থলে তাজুলের দুর্নীতির অক্টোপাসে আটকা পরেছে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম। এমনকি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাজুলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালকের কাছে অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা পায়নি। সরেজমিনসূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালটির পরিচালকের ভূয়া পিএস পরিচয়ধারী ও ক্ষমতাসীন দলীয় ছত্রছায়া প্রচার করে এই তাজুল পুরো হাসপাতাল জুড়ে মাসোয়ারা বাণিজ্য কায়েম করেছে। এর মধ্যে রয়েছে চিকিৎসাধীন ওয়ার্ডের আয়া-বুয়া থেকে মাসোয়ারা, ওটি রুমে রোগীদের সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতিসহ নিজের ফার্মেসীর ঔষধ কিনতে বাধ্য করা, পরিচালকের পিএস পরিচয় দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অবৈধ প্রভাব বিস্তার, বিভিন্ন প্রাইভেট ডায়গণস্টিক সেন্টারের রোগীর দালালি সিন্ডিকেট পরিচালনা করা।
সূত্র মতে, বিগত চার বছর আগে কন্টাক্ট সার্ভিসের (দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অস্থায়ী জনবল) মাধ্যমে শেবাচিম হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগে এমএলএসএস পদে কর্মরত হয়। এ ব্যাপারে ব্লাড ব্যাংকের দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ডাঃ নুরুন্নবি তুহিন বলেন, তাজুল ব্লাড ব্যাংকের চুক্তি ভিত্তিক কর্মচারী বর্তমানে পরিচালকের রুমে দ্বায়িত্ব পালন করছে। এদিকে উল্লেখিত অভিযোগের ব্যাপারে তাজুল বলেন, আমি ব্লাড ব্যাংকের অস্থায়ী কর্মচারী। আর পিএস পরিচয় দেয়ার কোন সুযোগ নেই কারণ হাসপাতালে পরিচালকের পিএসের কোন পদই নেই। হাসপাতালের ওটিতে আপানার মেহেন্দিগঞ্জ ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনতে বাধ্য করা হয় এছাড়া রোগীর অপারেশন হয় না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, হাসপাতালের সামনে আমার ভাইয়ের ফার্মেসী রয়েছে, এতে আমার কি। অথচ এমন সাদামাঠা বক্তব্যের বিপরীতে রয়েছে ভুক্তভোগীদের অসহায়ত্ব ভরা অভিযোগ। এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মজিবুর রহমান বলেন, গত ২০/২৫ দিন আগে আমার এক আত্মীয় মিজানুর রহমান হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগে চিকিৎসাধীন থেকে অপারেশনের জন্য সিরিয়াল পায়।
এরপর অপারেশন থিয়েটার (ওটি) থেকে ঔষধের তালিকা দিয়ে ঔষধ কিনতে বলা হয় হাসপাতালের সামনে থাকা মেহেন্দিগঞ্জ ফার্মেসী থেকে। আমার ঐ রোগী তাজুলের উক্ত ফার্মেসী খুঁজে না পেয়ে অন্য ফার্মেসী থেকে ঔষধ কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু অন্য ফার্মেসী থেকে ঔষধ কেনা হয়েছে বলে অপারেশন না করে ওটি থেকে বের করে দেয়া হয়। বিষয়টি আমার কাছে বলার পর রোগীকে দেয়া মেহেন্দিগঞ্জ ফার্মেসীর কার্ড নিয়ে পরিচালকের কাছে গিয়ে অভিযোগ করি এবং সেখানে তাজুলও উপস্থিত ছিলো। এরপর অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রফেসর ডাঃ মনিরুল ইসলাম উক্ত অভিযোগ শোনা মাত্র আতকে উঠে বলেন, আমি এখনই আপনার রোগীর অপারেশন করবো, পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি উক্ত রোগীর অপারেশন সম্পন্ন করেন। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় হলো এমন চাক্ষুস অভিযোগের পরও হাসপাতালের পরিচালক কোন প্রকার ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।
এনিয়ে কাউন্সিলর মজিবুর রহমান বলেন, আমি হাসপাতালের পরিচালককে তাজুলের অবৈধ কর্মকান্ডের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানানোর পরও কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। তাই একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাজুলের এহেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ দেয়ার জন্য ইতিমধ্যে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করছি। অপরদিকে, সম্প্রতি হাসপাতালের রেন্ট সেকশনের কাছেও পরিচালকের পিএস পরিচয় দিয়ে কেবিন হাতানোর চেষ্টা করে এবং এনিয়েও পরিচালকের কাছে নালিশ দেয় রেন্ট কালেক্টর মোঃ খোকন। ঘটনার সত্যতা জানতে চাইলে রেন্ট কালেক্টরেট খোকন বলেন, ভাই এ নিয়ে কিছু বলতে চাই না, এটা মিমাংসা হয়ে গেছে। এদিকে অপর একটি সূত্র জানায়, হাসপাতালের সামনের মেডিএইড ও ডক্টর’স ল্যাবের মালিকানা শেয়ার রয়েছে তাজুলের। যে কারণে হাসপাতালের চিকিৎসাধীন ওয়ার্ডগুলোর আউটসোর্সিং আয়া-বুয়াদেরকে বাধ্য করা হয় ওই সব নির্ধারিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীর টেস্ট করার জন্য। অন্যথায় আয়া-বুয়াদের চাকুরি থাকবে না বলে হুমকি দেয়া হয়।
এদিকে ২/৩ বছর আগে শেবাচিম হাসপাতালে ঔষধ চুরির ঘটনায় মামলার আসামি ছিলো এই তাজুল। শুধু তাই নয়, বর্হিবিভাগের চিকিৎসক ফয়সাল আহম্মেদ ও রমযানকে অনুরোধ করে কথিত ভিটামিন সিরাপ (পট কোম্পানির মতো) ফালসা রোগীর ব্যবস্থাপত্রে লেখায় এই তাজুল। এছাড়াও হাসপাতালে মারামারির কোন রোগী ভর্তি হলে মামলার কারনে জখমী সনদ নিতে রয়েছে তাজুলের হস্তক্ষেপ। তাকে ম্যানেজ করতে পারলেই সহসাই মেলে জখমি সনদ অন্যথায় ভুক্তভোগীর পড়তে হয় কালক্ষেপন খপ্পড়ে। হাসপাতালটির একাধিক ভুক্তভোগী সূত্র আরো জানায়, করেনাকালীন সময়ে হাসপাতালে ৩০ জন মজুরি ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করা হয় এবং তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তাজুল। শুধু তাই নয়, চিকিৎসাধীন ওয়ার্ডগুলোতে কন্টাক্ট সার্ভিসের মাধ্যমে আয়া-বুয়া নিয়োগ করে। কন্টাক্ট সার্ভিসের মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এরপরও চিকিৎসাধীন ওয়ার্ডগুলোতে অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে কাজ করছে এই জনবল। রোগীদেরকে টেস্ট করাতে বাইরে নিয়ে যাওয়া বা ট্রলি যোগে ওটি রুমে নিয়ে যাওয়াসহ নানামুখি প্রয়োজন মেটানোর কারণে রোগী ও স্বজনরা একেকজন আয়া-বুয়াকে ৩/৫শ টাকাও দেয়। আর উপরি আয়ের এমন চালচিত্র বেশি দেখা যায় মেডিসিন ও অর্থোপেডিক্স এবং সার্জারি বিভাগে। একেকটি ওয়ার্ডে কমপক্ষে ৫/৭জন এক্সটা আয়া-বুয়া কাজ করে। আর এদেরকে কাজ করতে হয় কথিত পিএস তাজুলকে মাসে ১/২হাজার টাকা মাসোয়ারা দিয়ে। অন্যথায় এই এক্সটা আয়া-বুয়াদেরকে কাজ করতে দেয়া হয় না। একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে একজন মেয়াদহীন আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীর এমন অবৈধ বলয় কি করে হাসপাতাল জুড়ে জেঁকে বসেছে এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একাধিক সূত্র জানায়, হাসপাতালের পরিচালকের সুনজরে রয়েছে তাজুল। তাছাড়া পরিচালকের সাথে বিভিন্ন সময়ে ফটোসেশনের ছবিগুলো সোস্যাল মিডিয়ায় এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে পরিচালকের কথিত পিএস বনে গেছে সে। এছাড়াও সার্বক্ষণিক পরিচালকের কক্ষে থাকে এবং তার ব্যক্তিগত ফুট ফরমায়েসও খাটে। সূত্র আরো জানায়, তাজুল হাসপাতালের বৈধ জনবল নয়। তিনি অস্থায়ী কন্টাক্ট সার্ভিসের জনবল এবং সেই কন্টাক্ট সার্ভিসের মেয়াদও শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগেই।
শেবাচিম হাসপাতাল জুড়ে তাজুলের এমন দুর্নীতির ব্যাপারে পরিচালক ডাঃ বাকির হোসেন বলেন, তাজুল আমার পিএস নয়। এটা যদি কেউ প্রচার করে তা হবে প্রতারণা। তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কে এই তাজুল এ নিয়ে অনুসন্ধানসূত্র জানায়, তাজুলের মূল বাড়ি বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া এলাকায়। একসময় শেবাচিম হাসপাতালে রোগীর দালালি থেকে এক পর্যায়ে ঔষধের ব্যবসা শুরু করে। এরপর কন্টাক্ট সার্ভিসের লোকবল হয়ে হাসপাতালে ঢুকে পড়ে। নিজেকে সরকারি দলের লোক বলে প্রচার করছে হাসপাতালে। অথচ উলানিয়া ইউনিয়েনের আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক মোঃ লালু বলেন, এই নামে কোন আ.লীগ কর্মী নেই এবং আগেও ছিলো না।