রাজনীতি
শহীদ জননীর শোকে গোটা বরিশাল
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ অপ্রত্যাশিত বিয়োগান্তে শোকের কালো মেঘ ছেঁয়ে ফেলেছে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সুতিকাগার সেরনিয়াবাত পরিবারকে। মৃত্যু অমোঘ সত্য। কিন্তু কেহই শহীদ জননী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগমের অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না। একইসাথে গোটা বরিশালজুড়ে আওয়ামী লীগের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের একমাত্র ভরসাস্থল জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মমতাময়ী সাহান আরা বেগমের শূন্যতায় গোটা বরিশালজুড়ে শোকের ছায়া বয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি সহধর্মীনি সাহান আরা বেগমের আকস্মিক মৃত্যুতে স্বামী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্য মন্ত্রী আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি ও জেষ্ঠ পুত্র বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ শোকে এখনও স্তস্মিত। সেই সাথে মেঝ পুত্র এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সেরনিয়াবাত মঈন আব্দুল্লাহ ও কনিষ্ঠ পুত্র জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সেরনিয়াবাত আশিক আব্দুল্লাহ শোকে মুহ্যমান। করোনার প্রভাবে একত্রিতভাবে বৃহত পরিসরে মরহুমা সাহান আরা বেগমের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া অনুষ্ঠান থেকে বিরত থাকলেও বরিশাল মহানগরীসহ জেলার দশটি উপজেলার প্রায় পাঁচ হাজার জামে মসজিদে নেতাকর্মীদের উদ্যোগে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ইতোমধ্যে দোয়া-মিলাদ এবং কয়েকশ’ মন্দিরে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও প্রশাসনিক ও বিভিন্ন সামাজিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিনিয়ত দোয়া-মিলাদ অব্যাহত রয়েছে। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রতিদিন নগরীর মুসলিম গোরস্থানে মরহুমা সাহান আরা বেগমের সমাধীস্থলে জড়ো হচ্ছেন আত্মার মাগফেরত কামনায়, দিচ্ছেন শ্রদ্ধাস্বরূপ ফুল। ফুলে ফুলে ঢেকে গেছে সাহান আরা বেগমের অন্তিম শয়নস্থল। শহীদ জননী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহান আরা বেগম শুধু বরিশালেই নয়; মেধা ও দক্ষতায় তিনি তার রাজনৈতিক সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ঢাকা পর্যন্ত নিজের পরিচিতি পেয়েছিলেন। সেই সাথে তিনি সাবেক সফল চীফ হুইপ ও বর্তমানে পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যাদায় থাকা আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র সহধর্মিনী এবং বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের জনপ্রিয় মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ’র মাতা। সেই হিসেবে তার (সাহান আরা বেগম) মৃত্যুর পর দলমত নির্বিশেষে বরিশালে লাখো মানুষের ঢল নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে মহামারি করোনার প্রকোপের কথা চিন্তা করে সেরনিয়াবাত পরিবারের নিকটতম আত্মীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বরিশালে কোন রকম আয়োজনের কর্মসূচি রাখা হয়নি। বরং বরিশালের দ্বিতীয় জানাজায় লোক সমাগমের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে স্বল্প সংখ্যক লোকের অংশগ্রহনের সুযোগ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এ মহিয়সী নারী সাহান আরা বেগমকে নগরীর মুসলিম গোরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত করা হয়েছে। এর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গত ৭ জুন রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সাহান আরা বেগমের মৃত্যুর পর হাসপাতাল চত্বরে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দলীয় একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার দীর্ঘবছরের সুখ ও দুঃখের সঙ্গি সাহান আরা বেগমকে হারিয়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারছেন না। স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে হওয়ার সুবাধে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে হাসানাত দম্পত্তিকে এতদাঞ্চলে মুজিব বাহিনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে শত কস্ট সহ্য করতে হয়েছে। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভয়াল কাল রাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে সাহান আরা বেগম নিজে গুলিবিদ্ধ হয়েও চোখের সামনে বড় ছেলে সুকান্ত বাবু সেরনিয়াবাতের ছটফট করে মৃত্যু দেখেছেন। একইসাথে সাহান আরা বেগম পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর নির্মমতা দেখেছেন। ঘাতকের নির্মম বুলেটে বাবা আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অসংখ্য সদস্য নিহত এবং নিজের স্ত্রী ও পরিবারের কয়েকজন সদস্য গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রানে বেঁচে গেলেও তাদের চিকিৎসার জন্য ওইসময় কিছুই করতে পারেননি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ। বরং ঘাতকদের চলে যাবার পর ঢাকার মিল্টো রোডের বাড়ির একটি রুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ স্ত্রীর অনুরোধে দেশ থেকে পালিয়ে দীর্ঘদিন ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার (হাসানাত) অনুপস্থিতিতে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য হয়ে কখনও খেয়ে কখনও না খেয়ে, আবার কখনও আত্মগোপনে থেকে শোকের সংসারে দীর্ঘদিন পর্যন্ত হাল ধরে রাখেন মমতাময়ী সাহান আরা বেগম। সেইসব দুঃখের অতীত স্মৃতি হাতরিয়ে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ মাঝে মধ্যে বিমর্ষ হয়ে চোখের জল কোনভাবে সংবরন করছেন তিন পুত্র শোকে ভেঙ্গে পরতে পারে এ আশংকা বিবেচনায়। আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সাথে আগৈলঝাড়ার সেরালের বাসায় অবস্থানকারী মেঝ পুত্র মঈন আব্দুল্লাহ ও কনিষ্ঠ পুত্র আশিক আব্দুল্লাহ উভয় তাদের প্রিয় মাকে হারিয়ে এখনও একপ্রকার বাকরুদ্ধ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। হাসপাতালে মায়ের মৃত্যুর সময় পাশে থাকা একমাত্র কনিষ্ঠ পুত্র আশিক আব্দুল্লাহ সেইদিনের স্মৃতি ভুলতে না পারায় হঠাৎ হঠাৎ ডুগরে কেঁদে উঠছেন। অপরদিকে বরিশাল শহরের কালিবাড়ি সড়কের দ্বিতল বাসভবনে একাকি থাকা বড় পুত্র বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ বেশ কয়েকদিন তার প্রিয় মাকে হারানোর শোকে মূহ্যমান হয়ে কারও সাথে দেখা করেননি। তবে গত কয়েকদিন থেকে করোনার মহামারিতে সিটি কর্পোরেশন এলাকাকে রেড জোন হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে চিহ্নিত করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত আসার পর তাকে (মেয়র) কয়েক দফায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিকভাবে এতোদূর অগ্রসরতা এবং তার যেকোন সমস্যা সমাধানে মায়ের অনুপ্রেরনায় আজকের অবস্থানে আসা সাদিক আব্দুল্লাহ কোনভাবেই মায়ের বিয়োগান্তের শোক সামাল দিতে পারছেন না। তাই একাকি একটি রুমে অবস্থান করে তিনি তার মায়ের স্মৃতিকে স্মরণ করে ডুকরে কাঁদছেন। প্রবাসে থাকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে স্ত্রী লিপি আব্দুল্লাহ ও সন্তানরা তার সাথে শোকের সাগরে ভাসলেও স্বামী সাদিক আব্দুল্লাহকে ফোনে সান্তনা দিয়ে রাখছেন। বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে বিমান চলাচল স্বাভাবিক না হওয়ায় প্রিয় শাশুরির মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও লিপি আব্দুল্লাহ তার সন্তানদের নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। লিপি আব্দুল্লাহ তার শাশুরি সাহান আরা বেগমের প্রতিছিলেন গভীর দূর্বল। সেই প্রিয় শাশুরীর মৃত্যুর সংবাদে তিনিও এখন ভঙ্গুর মানুষিকতায় শোকে মুহ্যমান। গোটা সেরনিয়াবাত পরিবার এখন সাহান আরা বেগমের শূন্যতা অনুভবে কাতর হয়ে পরেছেন। একসময় প্রাণচঞ্চল্যে ভরপুর সেরনিয়াবাত পরিবারের হঠাৎ শোকের যে ছাঁয়া নেমে এসেছে তা কিভাবে এবং কবে নাগাদ কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক হবে তা কেবল সৃষ্টিকর্তার উপরই নির্ভর করছে। একইসাথে বরিশালের ক্ষমতাসীন দলীয় রাজনীতির গতি প্রকৃতি নির্ভর করছে এ পরিবারের ওপর। সাহান আরা বেগমের আস্থাভাজন গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মাহিলাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে গোটা বরিশালজুড়ে যখন আওয়ামী লীগ সমর্থক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর বিএনপির সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হামলা, ভাংচুর, খুন, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ ও নারী নির্যাতনের ঘটনা চলছে। তখন সাহান আরা বেগম খবর পেয়েই প্রতিটিস্থানে ছুটে গিয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাহস জুগিয়ে মাতৃস্নেহ দিয়ে রেখেছেন। সেই থেকে দলের প্রকৃত ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের তিনি ছিলেন একমাত্র ভরসাস্থল। তার সেইস্থান কোনদিন পূরন হবার নয়। সেই মহিয়সী নারী সাহান আরা বেগম গত ৫ জুন আকস্মিকভাবে ঢাকার কলাবাগানের বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ৭ জুন রাতে সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। বরিশালের উজ্জল নক্ষত্র সাহান আরা বেগমের মৃত্যুকে ঘিরে গোটা বরিশালজুড়ে শোকের ছায়া বয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি সড়ক ও মহাসড়কে বিশালাকার কালোআকৃতির বিলবোর্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনে শোভা পাচ্ছে সাহান আরা বেগমের ছবি সংবলিত শোকের বাণী গাঁথা বিভিন্ন লেখায়-“ভোলা যায়না তোমায় হে মহিয়সী নারী, স্মৃতির পাতায় তুমি রবে অনন্তকাল বরিশালে”।