বরিশাল সদর
রোগীবান্ধব ডা: মাসুদকে হত্যাচেষ্টা ও হাসপাতাল ছাড়া করার মিশন
নিজস্ব প্রতিবেদক: মাসে লাখ লাখ টাকার কমিশন বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই রোগীবান্ধব চিকিৎসককে হত্যাচেষ্টা ও হাসপাতাল ছাড়া করার মিশনে নেমেছে শিক্ষানবিস চিকিৎসক সংগঠনের সভাপতি সজল পান্ডে ও প্যাথলজিস্ট চিকিৎসক আশিস দত্ত গংরা। রোগীদের টেস্ট করানো থেকে কমিশন হাতানোর এ মিশনে কয়েক বছর ধরে অচল করে রাখা হয়েছে শেবাচিম হাসপাতালের সিটিস্ক্যান ও ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগের কতিপয় টেস্ট কার্যক্রম। আর এই কমিশন সিন্ডিকেটের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রোগীদেরকে কম খরচে হাসপাতালেই টেস্ট করানোর উদ্যোগ নিয়ে গুরুতর হামলার শিকার হয়েছেন শেবাচিমের মেডিসিন বিভাগের সহকারি রেজিস্টার ডা: মো: মাসুদ খান। রাজনৈতিকভাবে হেনস্থা করতে ডা: মাসুদের ধর্মীয় অনুশাসন চর্চাকে পুঁজি করে জামায়াত-শিবিরের তকমাও জুড়ে দেয়া হয়েছে। অথচ ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের সাহচর্য ও মিটিং-মিছিল করে ছাত্রজীবন শেষ করেছেন।
এব্যাপারে সরকার দলীয় চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কুমিল্লা শাখার প্রচার সম্পাদক ডা: খন্দকার আব্দুল মুইত বলেন, ২০০৭-০৮ সালে ডা: মাসুদ ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো এবং সে সময়ে শিবিরের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগের ব্যানারে অংশ নিয়ে শিবিরের দখল করা কক্ষগুলোতে ভাঙচুরও করে। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার শিবিরের হামলার শিকার হন ডা: মাসুদ। আর চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি এখনো নেটে সার্চ দিলে পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, ডা: মাসুদের পৈত্রিক ভিটা মেহে্িন্দগঞ্জের আ’লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কাছেও দলীয় লোক হিসেবে বেশ পরিচিত। এ ব্যাপারে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা আ’লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম ভুলু বলেন, সে আ’লীগের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত এবং বিভিন্ন দলীয় প্রোগ্রামে অংশগ্রহন করে। শুধু তাই নয়, ডা: মাসুদ আমাদের দলীয় লোকদের চিকিৎসায় বেশ তৎপর।
ভুক্তভোভগী সূত্রে আরো জানা গেছে, হাসপাতালের রোগীদেরকে বাইরের ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলোতে না যেয়ে কম খরচে হাসপাতালের মধ্যকার বিভাগগুলোতে টেস্ট করানোর জন্য উৎসাহ দিয়ে আসছিলো ডা: মাসুদ। এনিয়ে কয়েকদফা ডা: মাসুদকে নিষেধ করা হয় রোগীদেরকে হাসপাতালের ভিতরে টেস্ট করানোর পরামর্শ না দিতে। নিষেধ না মানায় নিজ কক্ষে ডিউটিরত অবস্থায় ডা: মাসুদকে মুখ বেধে বেধড়ক পিটায় পান্ডে গংরা। এ ব্যাপারে আহত চিকিৎসক মাসুদ বলেন, চলতি মাসের ২০ তারিখ আমাকে শিক্ষানবিস চিকিৎসক সজল পান্ডে ও ৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী অভি, ৪৬ ব্যাচের শিক্ষানবিস চিকিৎসক তরিকুল ইসলামসহ বহিরাগত ৮/১০ জন মিলে মেডিকেলে ডিউটিরত অবস্থায় আমার কক্ষের দরজা বন্ধ করে হামলা চালায়। এতে আমার একটি কানের পর্দা ফেটে যায় এবং শরীর বিভিন্নস্থানে জখম তৈরী করে। হামলার সময় আমার পাশের কক্ষে নামাজরত অপর এক সহকর্মী বিষয়টি টের পেয়ে আমাকে ওয়ার্ডের অন্যান্যদের নিয়ে রোগীদের সহায়তায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আহতাবস্থায় আমি নাক কান গলা বিভাগে ভর্তি হলে সেখানে চিকিৎসা নিতে বাধা দেয় পান্ডে গংরা।
আর এঘটনার প্রেক্ষিতে আমি হাসপাতালের পরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেই এবং হাসাপাতালের প্রশাসনিক বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। সর্বশেষ কোতয়ালি মডেল থানায় হামলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করি এবং এনিয়ে এসআই আলামিন বলেন, ঘটনার তদন্ত চলছে। এদিকে সদ্য অনুমোদন প্রাপ্ত ইন্টার্নি ডক্টর এসোসিয়েশনের সভাপতি সজল পান্ডের ব্যাপারে একাধিক সূত্র জানায়, শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডের দুজন ৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী দিদারুল ও নুরুল ইসলামকে সম্প্রতি মারধর করে। সে বিষয়েও আহতরা পরিচালক বরাবর অভিযোগ দাখিল করলে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু অদ্যবধি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। এনিয়ে সজল পান্ডে বলেন, আমি ডা: মাসুধকে মারধর করিনি। কিন্তু ঘটনার আগে আপনি ডা: মাসুদকে ফোন দিয়ে প্রফেসর ডা: মাসুম আহম্মেদের কক্ষ থেকে মেডিসিন ওয়ার্ডের অফিস কক্ষে ডেকে আনেন। এসময় তিনি বলেন, উনি ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে হাসপাতালের সামনের ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলো থেকে চাঁদাবাজি করেন। কিন্তু ডা: মাসুদ তো মেডিকেলের ছাত্র নয়, আর যারা টাকা দিবে তারা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের নাম শুনেই টাকা দিয়ে দিবে এটা কি যৌক্তিক? তাছাড়া ডা: মাসুদের তো কোন ব্যক্তিগত চেম্বার নেই, সেখান থেকে রোগীদের নির্ধারিত ডায়গণস্টিক সেন্টার পাঠাবে। তাহলে ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলো কেন, কি কারনে তাকে টাকা দিবে? এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে সমর্থ হননি সজল পান্ডে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, রক্ত, প্রসাব, সিটিস্ক্যান, আলট্টাসনোগ্রাম, এক্সরেসহ বিভিন্ন টেস্টগুলোতে নির্ধারিত ডায়গণস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠানো হলে প্রতি টেস্টের ফি থেকে কমিশন বাবদ ৪০% থেকে ৫০% দেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় মাসে প্রায় লাখ লাখ টাকার কমিশন বাণিজ্য হয় কতিপয় ডাক্তারদের মাঝে। রোগীদের হাসপাতালের অভ্যন্তরীন বিভাগগুলোতে টেস্ট করতে না পাঠিয়ে কৌশলে উৎসাহ দেয়া হয় হাসপাতালের সামনের ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলোতে। যেকারণে ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলোতেও রোগী সমাগম থাকে। রোগী সমাগম ধরে রাখতে ডায়গণস্টিক সেন্টারগুলো হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডে নিজ নিজ দালাল ঠিক করে দিয়েছে। আর এই দালালদের সাথে রয়েছে আশিস ও পান্ডে গংদের একটি অর্থনৈতিক সখ্যতা। অপরদিকে, শেবাচিম হাসপাতালের সিটিস্ক্যান মেশিন প্রায় বছরেরও বেশি সময় ধরে অকেজো হয়ে আছে। আর এই অকেজো হওয়ার কারণে স্ট্রোক ও মাথায় আঘাতজনিত রোগীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ডায়গণস্টিক সেন্টার থেকে ৩/৪হাজার টাকা খরচ করে সিটিস্ক্যান করে। স্ট্রোক ও মাথায় আঘাতজনিত রোগীরা বেশিরভাগই ভর্তি হয় মেডিসিন বিভাগে সেক্ষেত্রে এতোদিন ধরে সিটিস্ক্যান বন্ধ থাকার কারণে রোগীরা স্বল্প টাকায় সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে মেডিসিন বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, সিটি স্ক্যানের ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই, এটা পরিচালক জানে। তাহলে আপনার বিভাগের রোগীরা অল্প খরচে সরকারি সিটিস্ক্যানের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সে ব্যাপারে আপনার কোন দাপ্তরিক দ্বায়িত্ব নেই বা আপনি কি লিখিতভাবে পরিচালক বরাবর বিষয়টি জানিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালের পরিচালক ডা:বাকির হোসেনকে ফোন দিলে তিনি বলেন, সিটিস্ক্যান বন্ধ, সেবা দিবে কিভাবে? এ ব্যাপারে মেডিসিন বিভাগের কর্তব্যরতদের জিজ্ঞেস করেন, কেনো সিটিস্ক্যান বন্ধ? কিন্তু মেডিসিন বিভাগের প্রধান সিটিস্ক্যান বন্ধ থাকার কারন আপানার কাছে জানতে বলেছে। এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা না জানালে আমি কিভাবে জানব বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। এককথায় সিটি স্ক্যান বন্ধ থাকার বিষয়টি নিয়ে কেউই সদুত্তর দেয়নি। আর এতে আরো স্পষ্ট হলো কমিশন বানিজ্যের সিন্ডিকেটের কালো ছায়া হাসপাতালজুড়ে। ডিউটিরত অবস্থায় মেডিসিন বিভাগের সহকারি রেজিস্টার ডা: মাসুদকে পান্ডে গংদের মারধরের ঘটনায় যে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে সে বিষয়ে পরিচালক আরো বলেন, তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়েছে এবং পাঁচ কর্মদিবসের ভিতরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এবং ইতিমধ্যে তিন কর্মদিবস পার হয়েছে।
এদিকে শেবাচিম হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি বিভাগে রয়েছে আশিস গংদের কালো থাবা। কুটকৌশলে প্যাথলজির হরমোন মেশিন ও সেল কাউন্টার মেশিন বন্ধ করে রাখা হয়েছে রিএজেন্ট না থাকার অজুহাতে। এছাড়াও রোগীদেরকে মুখস্থ রিপোর্টও দেয়া হয় যা মেডিসিন ওয়ার্ডের একাধিক চিকিৎসকদের কাছে প্রমাণিত। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের ভয়ে কেউই মুখ খুলতে চায়না। অথচ এহেন কর্মকান্ডের ব্যাপারে প্যাথলজি বিভাগে যেয়ে বিষয়টিতে প্রতিবাদ করায় ডা: মাসুদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাকে আশিস ও পান্ডে গংদের রোষানলে পড়তে হয়েছে। প্যাথলজির প্রধান ডা: আশিস দত্তের কাছে প্যাথলজির এহেন কর্মকান্ডের বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তা রিসিভ করেনি। অথচ একাধিকসূত্র জানায়, হাসাপাতালের সামনে একাধিক ডায়গণস্টিক সেন্টারের সাথে তার মালিকানা শেয়ার রয়েছে বেনামে। যাতে কোন তদন্তেও তার মালিকানা সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট না হয়। আর নামকাওয়াস্তে চালু রাখা হয়েছে হাসপাতালের প্যাথলজিকে। শেবাচিম হাসপাতালের এমন অসুস্থ্য পরিবেশের ব্যাপারে একাধিক রোগী ও স্বজনরা জানায়, হাসপাতালে ভর্তি পর কোন প্রকার টেস্ট করতে গেলে বাইরের ডায়গণস্টিকেই বেশি যেতে হয়। সিটি স্ক্যানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যয় সাপেক্ষ একটি চিকিৎসাসেবা দীর্ঘদিন থেকে হাসপাতালে বন্ধ রয়েছে। দখিন জনপদের প্রায় ৪০টি উপজেলা থেকে রোগীরা আসে চিকিৎসাসেবা নেয়ার জন্য কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যই বাহিরের ডায়গণস্টিক সেন্টারের উপর নির্ভর করতে হয়। আর চিকিৎসার পরিবেশতো কেমন তা সকলেরই কাছে দৃশ্যমানই।