জাতীয়
যে কারণে শীর্ষে ঢাকা ,শব্দ দূষণে
রিপোর্ট দেশ জনপদ ॥ এশিয়া মহাদেশই শুধু নয়, বিশ্বের সব দেশকে পেছনে ফেলে বারবার দূষণের শীর্ষে উঠে আসছে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশ। ভৌগলিকভাবে আশীর্বাদপুষ্ট প্রাণপ্রকৃতিতে ভরপুর একটি দেশের রাজধানীর এমন নেতিবাচক অর্জনের মূলে অসচেতনতা। দায়িত্ব জানার পরেও যথাযথ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়ার সক্ষমতার অভাব রয়েছে। যার প্রতিফলন বায়ু দূষণের পর শব্দ দূষণেও বিশ্বের শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য, যেখানে বিশ্বের ৬১ শহরের শব্দ দূষণের মাত্রা তুলে বিশ্লেষণ করা হয়। ’ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা এই প্রতিবেদনে আসা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৯৯ সালের গাইডলাইন) মানদণ্ড অনুসারে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। সে হিসেবেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচারে পিষ্ট।
ইউএনইপি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শব্দ দূষণের কারণে ইউরোপে প্রতি বছর ১২ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হয়, রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাতজনিত হৃদরোগীদের তালিকায় ৪৮ হাজার নতুন রোগী যুক্ত হন। এছাড়া শব্দের কারণে ইউরোপের দুই কোটির বেশির মানুষ বিরক্তিতে ভোগেন।
ঢাকায় কোথায় কতটা শব্দ দূষণ?
শব্দ দূষণ বলতে গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, কলকারখানা, মাইক ও লাউড স্পিকারের অসতর্ক ব্যবহার ইত্যাদিসহ বিভিন্ন উৎস থেকে উৎপন্ন জোরালো ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ। যা মানুষের সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে বিরক্তি ঘটায়।
বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছর ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের তথ্য-উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে। জরিপ কাজে শব্দের মান সংগ্রহে তাইওয়ানের প্রস্তুতকৃত Lutron ব্রান্ডের SL-4023SD মডেলের প্রথম শ্রেণির স্বয়ংক্রিয় সাউন্ড লেভেল ব্যবহার করে। স্থান হিসেবে ছিল, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, শাহবাগ, ধানমন্ডি-৩২, সংসদ এলাকা, তেজগাঁও, আগারগাঁও, গুলশান-২ ও মিরপুর-১০।
‘ক্যাপস’ এর জরিপ বলছে, ১০টি স্থানের নীরব এলাকায় ৯৬.৭% সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১.২% সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩.২% সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১% সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮.২% সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে।
এখানে লক্ষ্যণীয়, শব্দের সর্বনিম্ন যে মাত্রা রয়েছে তা নীরব এলাকার জন্য নির্ধারিত এবং সর্বোচ্চ মাত্রা শিল্প এলাকার জন্য নির্ধারিত। আদর্শ মানের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, নীরব এলাকায় দূষণের সময়ের পরিমাণ শিল্প এলাকা থেকে বেশি। সম্পূর্ণ ঢাকা শহরকে একটি মিশ্র এলাকার সাথে তুলনা করলে এই মেগা সিটির জন্য আদর্শ মান হতে পারে ৬০ ডেসিবল। সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৮২% সময় আদর্শ মান অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ সমগ্র ঢাকা শহরের ১০টি স্থানেই ৮২% সময় ৬০ ডেসিবলের উপরে শব্দ পাওয়া গিয়েছে।
জনসচেতনতার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
এ প্রসঙ্গে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘এমন তথ্য উদ্বেগের। পরীক্ষা করলে দেখা যাবে শব্দ দূষণের প্রভাবে আমরা রাজধানীর বেশির ভাগ মানুষ কানে কম শুনছি।’
কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শব্দ দূষণ রোধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারি। যে শিক্ষার্থী শিক্ষক হতে চায়, সে যেন পরিবেশ রক্ষায় সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধ তৈরি করার জন্য সচেষ্ট হয়। যে শিক্ষার্থী প্রকৌশলী হতে চায়, সে যেন তার উদ্ভাবনী জ্ঞানের মাধ্যমে এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, যা পরিবেশ দূষণ রোধ করবে। প্রকৃতি গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। সুতরাং টেকসই উন্নয়ন করতে গেলে আমরা যে যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি, যে অবস্থানেই থাকি না কেন, ছোট–বড় সবাইকে আমাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।’
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘শব্দ দূষণে আমরা আন্তরিক কাজ করে যাচ্ছি। এখানে আমাদের নাগরিকরা সব রকমের দূষণের সাথে জড়িত। প্রথমেই প্রয়োজন সচেতনতা। অধিদফতরের একটা শাখা শব্দ দূষণ রোধে কাজ করে যাচ্ছে অনবরত।’
জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা নীরব এলাকা ঘোষণা করেছি। তাও খুব একটা কাজে আসছে না। ম্যাজিস্ট্রেট বসিয়ে (মোবাইল কোর্ট) কতক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এর বাস্তবায়নে পুলিশকে ক্ষমতা দিতে হবে। যেহেতু সড়কে সারাক্ষণ পুলিশ উপস্থিত থাকেন। আমরা অনুরোধ করবো, দেশটা সবার। পরিবেশ রক্ষায় সবারই ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।’
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘দেশে পরিবেশ রক্ষায় যত ভালো ভালো আইন আছে, বিশ্বের বহু দেশেই এত ভালো আইন নেই। এখানে আইন বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। আমরা অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারি না।’
এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘যেখানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকার কথা, তা নেই। এমন অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এর জন্য দেশের বৃহৎ একটা অংশের আওয়াজ তুলতে হবে। আজকে পরিবেশ নিয়ে মানুষ যা ভাবছেন, তারও ভাবতে হবে। এই যে বিধিমালা হয়েছে, এর আগে আইন হওয়া জরুরি ছিল। আমরা শত চেষ্টা করার পরেও পারিনি। তাও বলবো, উন্নতি হয়েছে, আগে তাও ছিল না। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অগ্রসর হচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, ইউএনইপির প্রতিবেদনে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে শব্দ দূষণে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারতের মুরাদাবাদ, সেখানে শব্দের তীব্রতা ১১৪ ডেসিবল। আর তৃতীয় অবস্থানে আছে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ, সেখানে শব্দের গড় তীব্রতা ১০৫ ডেসিবল। ১০৩ ডেসিবল মাত্রার শব্দ দূষণ নিয়ে বাংলাদেশের উত্তরের শহর রাজশাহী বিশ্বের চতুর্থ স্থানে রয়েছে। একই মাত্রার শব্দ দূষণ হয় ভিয়েতনামের হো চি মিন সিটিতে। এশিয়ার শহরগেুলোর মধ্যে নেপালের কুপণ্ডোলে ১০০ ডিসিবল, থাইল্যান্ডের ব্যাংককে শব্দের তীব্রতা পাওয়া গেছে ৯৯ ডেসিবল, ফিলিপিন্সের ম্যানিলায় ৯২ ডেসিবল, ভারতের নয়া দিল্লিতে ৮৩ ডেসিবল। আর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ৯৯ ডেসিবল, নাইজেরিয়ার ইবাদানে ১০১ ডেসিবল শব্দের দূষণ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘের এই সংস্থার তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের আরেক শহর টাঙ্গাইলের নাম। সেখানে শব্দের তীব্রতা পাওয়া গেছে ৭৫ ডেসিবল। এই তালিকার শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম শব্দ দূষণ হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে, সেখানে শব্দের সর্বোচ্চ গড় তীব্রতা ২০ ডেসিবল। এরপর দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্পেনের বার্সেলোনা, ২২ ডেসিবল।