বরিশাল
মাছের রাজ্যে মাছের আকাল জেলে পল্লীতে হাহাকার
নিজস্ব প্রতিবেদক : দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলে পল্লীগুলোতে অভাব-অনটনে সর্বাবস্থায় হাহাকার। গত ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ দুই মাস মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল।
ওই নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর নদীতে গিয়ে আশানুরূপ মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন জেলেরা। তাছাড়া দাদন ও সুদের দেনার ফাঁদেও আটকে আছেন জেলেরা। দেনা থেকে মুক্তি মিলছে না মৃত্যুতেও। এতে বলা যায়, মাছের রাজ্যে মাছের আকাল। জেলে পল্লীতে হাহাকার।
নদীতে গিয়ে আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় দিনের পর দিন বাড়ছে সুদের মুনাফা, জেলেদের জীবন কাটছে দুরাশায়, চোখে মুখে দেখছেন শুধু কুয়াশা। অন্যদিকে, জেলে পল্লীর শিশু-কিশোররাও দিন দিন ঝরে পড়ছে পড়ালেখা থেকে। তারা বেছে নিয়েছেন বাপ-দাদার মাছ ধরার পেশা।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৪ হাজার ৮০৬ জন। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা কমপক্ষে ৩০ হাজার। যারা কেবল মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল।
লালমোহন উপজেলার মেঘনা ও তেতুলিয়া নদী এলাকায় ছোট-বড় কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০টি মৎস্যঘাট থেকে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে যায়। উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
উপজেলার কোভখালী ও গাইট্রার খাল মাছ ঘাটের জেলে মো: নাজিম উদ্দীন (৪০) ও মো: আলী (৩৮)। তাদের পেশা শুধু মাছ শিকার করা। তাদের বয়সের বেশিভাগ সময়ই কাটিয়েছেন মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে। এই নদীই তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম।
বুড়িরদোন ঘাটের মৎস্যজীবী মো: শাহে আলম মাঝি বলেন, ‘সম্প্রতি শেষ হওয়া নিষেধাজ্ঞা শেষে ১৫ জন জেলেসহ মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে যাই। একদিন নদীতে মাছ ধরার জন্য ট্রলারের তেল, চাল, ডাল এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
সারারাত মাছ ধরে সকালে ঘাটে ফিরে মাছ বিক্রি করেছি মাত্র সাত থেকে আট হাজার টাকার। সেখান থেকে কমিশন বাবদ প্রায় ৯০০ টাকা কেটে রেখেছেন আড়তদার। লাভ তো দূরের কথা, ওই দিন লোকসানই হয়েছে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এতে করে দিনের পর দিন দেনার পরিমাণ কেবল বাড়ছেই। নদীতে তেমন মাছ না থাকায় এখন আর মাছ ধরতে যাইতে ইচ্ছে করে না।’
সর্দারের খাল মাছ ঘাটের জেলে মো: রফিক মিয়ার মতো এমন অনেক জেলেই লোকসানের ভয়ে নদীতে যাচ্ছেন না বলে এ প্রতিনিধিকে জানান। যার ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাবে দিন কাটছে লালমোহন উপজেলার বেশিভাগ জেলেদের।
ওই মৎস্যঘাটের মোসলে উদ্দীন মাঝি, আজাহার মাঝিসহ আরো বেশ কয়েকজন জেলে জানায়, আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, যখন নদীতে মাছ থাকে তখন মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। আর যখন মাছ থাকে না তখন নিষেধাজ্ঞাও থাকে না। এ কারণেই মূলত আমরা মাছ পাচ্ছি না, ধার দেনায় জড়িয়ে থাকি বছরের পর বছর। তাই মৎস্য বিভাগসহ সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ রইলো সামনের দিকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার।’
ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাতিরখাল মৎস্যঘাটের জেলে আনিচল হক-সহ আরো একাধিক জেলে বলেন, ‘মহাজনরা আড়তদারদের কাছ থেকে দাদনের টাকা নিয়ে নৌকা বা ট্রলারে থাকা অন্য জেলেদের মাঝে টাকা বিতরণ করেন। এরপর মহাজন নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় দাদনের টাকা নেয়া ১৫ থেকে ১৬ জন জেলেকে সাথে নেন।
জেলেরা মাছ ধরা এবং বিক্রির ওপর টাকা পায়। দেখা যায়, জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে আড়তদারের কাছ থেকে যে টাকা নেন, মাছ না পেলে ওই টাকা দেনাই থেকে যায়। আবার নতুন করে মাছ ধরতে গেলে আড়তদারের কাছ থেকে আবারো দাদন নিয়ে যেতে হয়। এভাবে দাদনের টাকা বাড়তে বাড়তে এক সময় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। জেলেরা যতদিন নদীতে মাছ ধরবে ততদিন আড়তদার দাদনের টাকা ফেরত চায় না।’
তারা আরো জানায়, ‘জেলেরা যখন মাছ ধরা ছেড়ে দেয় তখনই ফয়সালার মাধ্যমে আড়তদারের টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই টাকা ফেরত দিতে গিয়ে দেনাগ্রস্ত অনেক জেলেকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়। যার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও অনেকে জেলে পেশা ছাড়তে পারছেন না।
এভাবেই বেশিভাগ জেলেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পেশায় জড়িয়ে বেড়াতে হয় দাদনের বোঝা। মৃত্যুর পরও মেলে না মুক্তি। কারণ দাদন নিয়ে মারা গেলেও জেলেদের ওয়ারিশরা দাদনের ওই টাকা ফেরত দিতে হয়।’
অন্যদিকে, জেলেপল্লীর শিশু-কিশোররাও ঝরে পড়ছে লেখাপড়া থেকে। পড়ালেখা ছেড়ে তারা জড়াচ্ছেন বাপ-দাদার মাছ ধরা পেশায়। কামারের খাল ও জোড়া খাল মৎস্যঘাটের এমনই কয়েকজন শিশু ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সীকে দেখা যায়।
বিদ্যালয়ের বারান্দায় তাদের ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, তবে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কোনো রকমে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে। তখন থেকে মাঝে মধ্যে স্বজনদের সাথে নদীতে যাওয়া শুরু হয় শিশু কিশোরদের। একপর্যায়ে নদীতে মাছ শিকার করা তাদের পেশা হয়ে যায়।
মেঘনা তীরবর্তী এলাকার শিপন ও রিয়াজ নামের দুইজন শিশু জানায়, ‘স্বজনদের সাথে প্রথমে শখ করে নদীতে যাওয়া শুরু করি। সেই শখই এখন পেশা। প্রথম প্রথম নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে ভয় হতো। তবে এখন সেই ভয় কেটে গেছে।
এখন স্থানীয় অন্যান্য জেলেদের সাথে নিয়মিত মাছ শিকারে যাই। যেদিন মাছ শিকারে যাই সেদিন কখনো ২০০, কখনো ৪০০ টাকা পাই। আবার কখনো খালি হাতেই ফিরতে হয়। যখন নদীতে গিয়ে মাছ ধরে টাকা পাই, তখন ওই টাকা মা-বাবার হাতে তুলে দিই।’
লালমোহন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো: আলী আহমদ আখন্দ বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নদীতে মাছ কম আসে তবে সাগরে প্রচুর মাছ রয়েছে। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে মাছ পড়বে। তবে প্রচুর বৃষ্টি হলে নদীর পানি বাড়বে, তখন নদীতে মাছও আসবে।
এরপর জেলেরা নদীতে গিয়ে তাদের আশানুরূপ মাছ পাবেন। এছাড়াও ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন সময় জেলেদের মাঝে বৈধ জাল বিতরণ ও বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য বকনা বাছুর বিতরণ করা হচ্ছে। আমাদের আশা এর মাধ্যমে জেলেরা কিছুটা হলেও ঋণের বোঝা থেকে রক্ষা পাবেন।