ভোলা
ভোলায় হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর রসের ঐতিহ্য
নিজস্ব প্রতিবেদক॥ শীতের সকালে খেজুরের রসের বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলি আর পায়েস ছিল ভোলার গ্রামাঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। এসব খাওয়ানোর মাধ্যমেই পরিপূর্ণ হতো অতিথি আপ্যায়ন। কিন্তু দিন দিন এ জেলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুর গাছ। যা আছে, সেগুলো থেকে আগের মতো রস পড়ে না। ফলে গাছ কাটা বন্ধ কবরে দিয়েছেন গাছি। তাই আগ্রহ থাকলেও সহজে মিলছে না রস।
ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর, ভেদুরিয়া, ভেলুমিয়া ও পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, এক সময় গ্রামাঞ্চলের রাস্তার দুই পাশে এবং ফসলি জমির পাশে দেখা মিলত খেজুর গাছ। শীত এলেই রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ প্রস্তুত নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতেন গাছিরা।
প্রস্তুত হওয়া শেষে বিকেল হলেই খেজুর গাছে মাটির তৈরি হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিতেন তারা। ভোর হলেই গাছ থেকে হাঁড়ি নামিয়ে রস সংগ্রহ করতেন। আর টাটকা রস দিয়ে পিঠা ও পায়েস বানাতে গাছের কাছেই ভিড় জমাতেন ক্রেতারা। কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। স্থানীয়দের দাবি ফসলি জমির ওপর নতুন নতুন ঘরবাড়ি গড়ে ওঠার কারণে খেজুর গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। অল্প সংখ্যক যে গাছ ঝিল তাও অযত্ন ও অবহেলায় দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন নতুন প্রজন্মের কাছে রসের বাহারি পিঠা ও পায়েস পরিণত হয়েছে রূপকথার গল্পে।
ভোলা সদর উপজেলার আলী নগর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁঠালি গ্রামের বাসিন্দা মো. আব্দুর রব বলেন, আমাদের গ্রামে আগে অনেক খেজুর গাছ ছিল। খেজুর রসের মিঠাই দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও পায়েস খেয়েছি। কিন্তু বর্তমানে আমাদের গ্রামে খেজুর গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই আমরা আগের মতো খেজুরের রসের পিঠা ও রসের পায়েস খেতে পারি না। আমাদের ছেলে-মেয়েদের এসব খাওয়াতেও পারি না। তাই তারা খেজুরের রসের পিঠা ও পায়েসের স্বাদও জানে না।
ভোলা পৌর ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আজাদ হোসেন বলেন, ছোট বেলার আমাদের বাবা-মা খেজুরের রস খাওয়াতেন। খেজুরের গুড়ের বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও সকালে রসের পায়েস খাওয়াতেন। আমরা খেয়েছি। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো খেজুরের রসের কোনো কিছুই খেতে পারছে না। তারা শুধু বইপত্রে জানছে খেজুরের রসের বিভিন্ন ধরনের পিঠা ও পায়েসের কথা।
ভোলা সদর উপজেলার পশ্চিম ইলিশা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ সদুরে চর গ্রামের সচেতন নাগরিক বাসিন্দা মো. হারুন অর রশিদ শিমূল বলেন, বর্তমানে খেজুর গাছ বিলুপ্তির পথে। এ অবস্থায় সরকার যদি কোনো প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে খেজুর গাছ রোপণ করে এবং যেসব খেজুর গাছ রয়েছে সেগুলোকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করে তাহলেই রসের ভাণ্ডার হবে। তাহলে আগামী প্রজন্ম খেজুরের রসের পিঠা ও পায়েস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে না।
গাছি মো. আলী বলেন, ছোট বেলা থেকে আমার বাবার কাছ থেকে খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা শিখিয়েছেন। আমার বাবা আগে ৬-৭০০ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতেন। সেই রসের কিছু কাঁচা বিক্রি করতেন আর কিছু জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। সেই গুড় বাজারে ভালো দামে বিক্রি করে দিতেন। এভাবে বাবার তিন-চারমাস রসের পেছনেই চলে যেত। আর খেজুরের গুড় বছরের প্রায় ১২ মাসই বাজারে বিক্রি করতেন। তিনি এসব করেই আমাদের সংসার চালাতেন।
আলী আরও বলেন, বাবার মৃত্যুর পর প্রায় ১৫ বছর ধরে আমি খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছি। ৭ বছর আগেও ২-৩০০ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতাম। কিন্তু কেটে ফেলা এবং অযত্নে নষ্ট হয়ে দিন দিন খেজুর গাছ কমে গেছে। বর্তমানে ২০-২৫টি গাছ থেকে রস পাই। রসের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় যা হয় তা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিক্রি করে ফেলি। আবার কেউ বাড়িতে এসে নিয়ে যায়। প্রতি হাঁড়ি রস ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি করি। অনেক গাছি খেজুর গাছ কাটা ছেড়ে দিয়েছেন। আমিও হয়তো আগামী বছর আর কাটবো না।
ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হাসান ওয়ারিসুর কবীর খেজুর গাছ বিলুপ্ত হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের খেজুর গাছ ও তাল গাছ রোপণের একটি কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করি আগামী ১০ বছরের মধ্যে খেজুর গাছের অভাব দূর হবে এবং খেজুরের গাছে রসের সেই দিন ফিরে আসবে।