বরিশাল সদর
বরিশাল কারাগার যেন টাকার খনি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলো পথ” এই বাক্যটি বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে। কারাগারের কর্তৃপক্ষও দাবি করেছেন, বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রতিটি বন্দিকে রাখা হয় নিবির পর্যবেক্ষণে। কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে দেখানো হয় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ। তবে অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে এর পুরো উল্টো চিত্র। পুরো কারাগার জুড়েই চলছে টাকার খেলা। যার যত বেশি টাকা, সে তত বেশি প্রভাবশালী বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে। আর যাদের টাকা নেই তাদের হতে হয় কারাকর্তৃপক্ষের নির্যাতনের শিকার। কারাবন্দিদের জিম্মি করে অন্তত ৫ ধাপে আদায় করা হয় লাখ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে বন্দি বেচা-কেনা, সাক্ষাৎ বাণিজ্য, সিট বাণিজ্য, খাবার বাণিজ্য এবং জামিন বাণিজ্য। এখন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার যেন টাকার খনিতে পরিনত হয়েছে। যেখানে এক কেজি গরুর গোশ ১১শ’ টাকা। এর সাথে রান্না খরচ ২শ’ এবং মসলার জন্য ৩শ’ টাকা। অর্থাৎ এক কেজি গরুর গোশত রান্না করে খেতে মোট গুণতে হবে ১৬শ’ টাকা।
বিষয়টি অবাক করার মতো হলেও বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে এটাই বাস্তবতা। শুধুমাত্র খাবার বিক্রি করে আসামীদের কাছ থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন কারা কর্তৃপক্ষ। আর এ আয়ের সবচেয়ে বড় অংশ পাচ্ছেন জেলার ও জেল সুপার। মোট আয়ের ৪০ শতাংশ দিতে হয় এই দুই কর্মকর্তাকে। এতো গেলো শুধু গোশতের পর্ব। বাইরে যে ব্রাশ পাওয়া যায় ২০ টাকায় সেই ব্রাশ কারাগারে কিনতে হবে ১০০ টাকায়। এক হালি পোল্ট্রি মুরগীর ডিমের দাম ৮০ টাকা, ছোট রুই মাছের কেজি ৬শ’ টাকা, ব্রয়লার মুরগীর কেজি ৩শ’ টাকা। এভাবে শুধু খাবারেই নয়, প্রতিটি পদে পদে দুর্নীতি চলে কারাভ্যন্তরে। আর এ দুর্নীতি ও অনিয়মের মূল নায়ক কারাগারের জেলার। শুধু খাবারে টাকা নেয়াই নয়, কথায় কথায় আসামীদের উপর চলে নির্মম নির্যাতন।
গত ৫ বছর ধরে একটি ডাকাতি মামলায় হাজতবাস করছেন নয়ন। গেলো ২৫ রমজান এক প্লেট ভাতের জন্য প্রচন্ড মারধর করা হয় জেলার শাহ আলমের নির্দেশে। জেলার শাহ আলম তাকে হাতে-পায়ে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে চোখে কয়েদী গামছা প্যাঁচিয়ে পুলিশের লাঠি দিয়ে মারধর করে। এ নিয়ে কারাগারে উত্তেজনা দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে হয় জেলারকে। একটি চেক প্রতারণা মামলায় কয়েক মাস ধরে কারাগারে আছেন লিটন সরকার (কীর্তনখোলা-৪ হাজতী ওয়ার্ড)। কারাগারের ভেতরে ভালো থাকতে হলে অর্থ দাবী করা হয় লিটনের কাছে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ১২ নম্বর সেলে দেয়া হয় তাকে। এরপর তার উপর চালানো হয় অমানষিক নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে হারপিক খেয়ে গত ১০ জুন আত্মহত্যার চেষ্টা করে লিটন সরকার। একাধিক আসামীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের ভেতরে মেডিকেল সুবিধা পাওয়ার জন্য সাড়ে চার হাজার টাকা দিতে হয় মাসে। এই টাকার বিনিময়ে সেখানে একটি খাট, টিভিসহ আরও অনেক সুবিধা আছে। নিয়মানুযায়ী প্রকৃতপক্ষে যারা অসুস্থ তাদের জন্যই এ সুবিধা থাকবে। কিন্তু টাকার বিনিময়ে প্রকৃত অসুস্থ আসামীদের বাদ দিয়ে যারা সুস্থ্য আছেন তাদেরকে এই সুবিধা দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানাগেছে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে এই সুবিধা পাচ্ছেন মাদক, ডাকাতি ও হত্যা মামলার আসামীরা। মেডিকেলের প্রত্যেক রোগীদের জন্য ১০ নম্বর ডায়েট বরাদ্দ রয়েছে প্রতিদিন। কিন্তু টাকা দিয়ে সব রোগী থাকার পরেও তাদের খাবার দেয়ার জন্য অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কেন্টিন থেকে খাবার নিতে হয়। বর্তমান জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দীন হায়দার কারাগার পদির্শনকালে ২২টি এলইডি টিভি প্রদান করেন। কিন্তু ৮টি টিভির কোন হদিস নেই। অভিযোগ রয়েছে ওই টিভি বাইরে বিক্রি করে দিয়েছেন জেলার। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক বন্দীর কাছ থেকে টিভি দেখার জন্য ওয়ার্ড ভিত্তিক এক হাজার টাকা জেলার দাবী করেন। বন্দীরা এই টাকা দিতে অস্বীকার করায় জেলার টিভিগুলোর পোর্ট ভেঙ্গে ফেলেছেন। দুর্নীতির এখানেই শেষ নয়। জেল কোড অনুযায়ী কয়েদীদের প্রতি মাসে কাজ পাস করার নিয়ম আছে। কিন্তু জেলার সিডর-৯নং ওয়ার্ডে ৮ হাজার টাকা, সিডর ১১-১২ ওয়ার্ডে ৬ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। সাক্ষাতকারের ঘরের কাজটি ১২ হাজার টাকায় ২ মাসের জন্য জেলারের কাছ থেকে নিয়েছেন কয়েদী সাইফুল।
কিন্তু এটা কোন বিধানে নেই। কিন্তু জেলারকে টাকা দিলেও সব অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া এক আসামী জানান, মেডিকেল চৌকায় রোগীদের জন্য রান্না করা হয়। এ রান্না করার জন্য কয়েদীদের কাজ পাস দেয়া হয়। কাজ পাসের জন্য ছয় হাজার টাকা করে নেয়া হয়। ২/৩ মাসে চৌকায় কাজ পায় ধোপা খোকন, কালা সেলিম। এরা জেলারকে ৬ হাজার টাকা দিয়ে কাজ নিয়েছেন। কাজ নিয়ে তারা চৌকার দুধ, মাছ, গোশ, তৈল চুরি করে অন্যত্র বিক্রি করেন। গুদাম থেকে সয়াবিন তেলের ব্যারেল, আলু, মুসুরী ডাল জেলারের হুকুম মোতাবেক করনীক কারা কেন্টিনে বিক্রী করে দেন। অথচ এসব কেন্টিনে বিক্রীর কোন বৈধতা নেই। অপর এক আসামী বলেন, কেস টেবিলে (যেখানে আসামীদের বিচার বৈঠক হয়) নতুন আসামীদের কাছ থেকে নগদ/পিসি অর্থের বিনিময়ে চীফ রাইটার ইব্রাহীম বকস বিভিন্ন আসামীদের পছন্দমত ফাইল কেটে দেন। এই অর্থের ৫০ শতাংশ যায় জেলারের পকেটে। কোন হাজতী নি¤œ ও উচ্চ আদালত থেকে জামিন হলে গেট থেকে ডিবি ধরে নিয়ে যাবে, অথবা তার জামিন পেপারে ভুল আছে এই কথা বলে জামিন প্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে নগদ অর্থ আদায় করা হয়। এই টাকা সংগ্রহ করে কয়েদী শাখায় কর্মরত বাদল নামে এক কারারক্ষী। বাদল ও চীফ রাইটার ইব্রাহীম বকস জেলার শাহ আলমের অঘোষিত ম্যানেজার।
গেলো ৭ জুন সিডর-২ নং ওয়ার্ডে রাত সাড়ে ৮টায় কয়েদী আসামী হানিফকে তল্লাশী করে একটি চাকু, তিনহাত পরিমাণ একটি তার ও ৫০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা করে জেলার। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে জেলার রিপোর্ট ছাড়াই কেস টেবিলে হাজির না করে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মাফ করে দেন। এ ব্যাপারে জেলার শাহ আলমের কাছে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কারাগারে কারো উপর নির্যাতন করা হয় না। যদি এ ধরণের অভিযোগ থাকে তাহলে আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করা হোক। তারা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। তবে এক আসামী হারপিক খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এটা সত্য। ওই ব্যক্তি এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তিনি কি কারণে হারপিক খেয়েছেন তা জানি না। সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসার পর জানা যাবে।