জাতীয়
মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য দাখিল
বরিশালে ইউনিয়ন বিভক্ত করায় উচ্চ আদালতের রুল জারী
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ মিথ্যা ও মনগড়া তথ্য দাখিল করে এবং ইউনিয়ন পরিষদ আইনের সকল ধরনের নীতিমালা অমান্য করে মেঘনা নদীর ভাঙনে এক তৃতীয়াংশ বিলীন হয়ে যাওয়া বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউনিয়নকে দুই ভাগে বিভক্ত করায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার, বরিশাল জেলা প্রশাসকসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে রুল জারী করেছে মহামান্য হাইকোর্ট। উলানিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা মোঃ মিজানুর রহমান এবং সৈয়দ আকবর আলী চৌধুরীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৪ আগষ্ট হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ আশফাকুল ইসলাম ও মোহাম্মাদ আলীর যৌথ বেঞ্চ এই রুল জারি করেন। রুলে বিচারপতিদ্বয় দুই সপ্তাহের মধ্যে বিবাদীদেরকে জবাব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে রুলের নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত বিষয়ে পরবর্তী কার্যক্রম করা যাবেনা মর্মে হাইকোর্টের আইন ও বিধি নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বিবাদী পক্ষ ইউনিয়ন পরিষদ বিভক্তি কার্যক্রম বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি কার্যক্রম পরিচালনা অব্যহত রেখেছেন বলে অভিযোগ রিটকারীদের। এই ঘটনায় রিটকারীদ্বয় গত ৩ সেপ্টেম্বর রিটের বিবাদী বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলা প্রশাসক বরাবর হাইকোর্ট কর্তৃক রুলের জবাব প্রদানের অনুরোধ ও ইউনিয়ন বিভক্তিকরণের সকল কার্যক্রম স্থগিত রাখার জন্য লিখিতভাবে আবেদন জানিয়েছেন। অপরদিকে হাইকোর্টের দেয়া রুল জারির সময়-সীমা প্রায় দেড়ম াস অতিবাহিত হলেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত (গতকাল রবিবার) বিবাদী পক্ষ রুলের জবাব দেয়নি। এই অভিযোগে রিটকারীগনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিষ্টার রেদোয়ান আহমেদ গত ১৪ সেপ্টেম্বর উল্লেখিত বিবাদীসহ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনের সচিব, বরিশাল জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা সহ ১১ জনকে আইনী নোটিশ প্রেরণ করেছেন। জানা যায়, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়া ইউপির নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. আলতাফ সরদারের মৃত্যুতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব নিয়ে গত ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ইউনিয়ন বিভক্তির আবেদন করে ১নং প্যানেল চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান। স্থানীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথের সুপারিশকৃত ওই আবেদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রেরণ করা হলে অনেকটা গোপনীয়ভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয় উলানিয়া ইউনিয়নকে। আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে একদিকে নির্বাচন কার্যক্রম বন্ধ, অন্যদিকে মিথ্য তথ্য সরবরাহ করে শক্তিশালী একটি ইউনিয়নকে দুর্বল করাই মহল বিশেষের কাজ বলে স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে মনে করেন। এদিকে আবেদনকারী প্যানেল চেয়ারম্যান মোঃ হাবিবুর রহমান বলছেন-সকল নীতিমালা মেনেই ইউনিয়ন বিভক্তির তথ্য সরবরাহ ও আবেদন করা হয়েছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবী- তথ্য যাচাই-বাছাই পূর্বক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। স্থানীয় বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ বাসিন্দারা জানান, বরিশালের উল্লেখযোগ্য ইউনিয়নগুলোর মধ্যে উলানিয়া ইউনিয়নটি অন্যতম। দীর্ঘ কয়েক যুগ ধরে মেঘনা নদীতে মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলটি ভাঙনের শিকার হয়ে আসছে। ইতিপূর্বে উলানিয়া ইউনিয়নের পাশ্ববর্তী গোবিন্দপুর ইউনিয়নটি সম্পূর্ণভাবে নদী গর্ভে হারিয়ে যায়। গত ৪/৫ বছর যাবত মেঘনার ভাঙনের মুখে পড়ে বেশ কয়েকটি গ্রামের সিংহভাগ বিলীন হয়েছে। নদী ভাঙনের শিকার সাধারণ মানুষ যখন বসতি স্থাপনে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে চলতি বছরের ২১ আগষ্ট ইউনিয়নটিকে দুই ভাগে বিভক্তি করা হয়। জানা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের (ইউনিয়ন পরিষদ) নীতিমালায় রয়েছে- নতুন যেকোন ইউনিয়ন স্থাপনে তার আয়তন কমপক্ষে ২০ বর্গ কিলোমিটার হতে হবে। কিন্তু পুরো উলানিয়া ইউনিয়নের আয়তন হচ্ছে ২৪.৬৮ বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে ৭ বর্গ কিলোমিটার ইতিমধ্যে মেঘনার তলদেশে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে স্থলভাগে থাকা ইউনিয়নের ১৭.৪ বর্গ কিলোমিটারের তথ্য গোপন করে নদীর তলদেশের তথ্য সামনে এনে ২৪ দশমিক ৬৮ বর্গ কিলোমিটারকে দুই ভাগে বিভক্ত করে উলানিয়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ করা হয়েছে। বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখা থেকে মন্ত্রনালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামের মধ্যে ৯টি উত্তর উলানিয়া ও ৪টি গ্রাম দিয়ে দক্ষিণ উলানিয়া করার প্রস্তাবনা করা হয়েছে। ১২.২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের যে ৪টি গ্রাম নিয়ে নব গঠিত দক্ষিণ উলানিয়া করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি গ্রামের পঞ্চাশ শতাংশ মেঘনায় বিলিন। অন্যদিকে ১২.৬৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের যে ৯টি গ্রাম নিয়ে নবগঠিত উত্তর উলানিয়া ইউনিয়ন করা হয়েছে তার মধ্যে তিনটি গ্রামের অধিকাংশ মেঘনায় বিলিন হয়ে গেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন সরদার গত ২০১৭ সালের ২৯ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান লিটন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে মাত্র তিন মাসের মাথায় ইউনিয়নকে দুই ভাগে বিভক্তকরণের জন্য একটি আবেদন করেন। তিনি তার আবেদনে উল্লেখ করেন-উলানিয়া ইউনিয়নের নাগরিক তুলনামূলক অনেক বেশী। যার নাগরিক সেবা উলানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ দিতে ব্যর্থ। তাই ইউনিয়নটি দুই ভাগে বিভক্ত করা প্রয়োজন। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে সঠিক সরেজমিন তথ্য সরবরাহ না করার অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয়রা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক স্থানীয় সাবেক ও বর্তমান মেম্বার এবং চেয়ারম্যান বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী এই ইউনিয়নটিতে নির্বাচিত চেয়ারম্যান-মেম্বাররা নাগরিক সেবা দিয়েছে। আর বর্তমানে নদী ভাঙনে ছোট হয়ে আসা ইউনিয়নবাসীর সেবা দিতে পারছেন না কোন যুক্তিতে। বর্তমান ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ড সদস্য আরিফুর রহমান সবুজ বলেন, আমার ওয়ার্ডের সত্তর ভাগ এলাকা মেঘনা নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। একই কথা বলেন ইউনিয়নের ২ ও ৩নং ওয়ার্ড সদস্য ইয়াসিন রাজু এবং আব্দুল মতিন। ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ জামাল হোসেন মোল্লা বলেন, আমি চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় ২০১১ সালে ইউনিয়নের স্থলভাগের আয়তন ছিলো ১৭.০৫ বর্গ কিলোমিটার।