রাজনীতি
বরগুনায় নয়া বন্ড গ্রুপের ত্রাস
বরগুনা প্রতিনিধি :: ‘নয়ন বন্ড’ গ্রুপের পর বরগুনায় এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটি উঠতি সন্ত্রাসী বাহিনী। অনেক ক্ষেত্রে আরও ভয়ঙ্কর রূপে তৎপরতা চালাচ্ছে নয়া ‘বন্ড’রা। এলাকাভিত্তিক আধিপত্য, মাদক কারবার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণসহ সব অপকর্মই করছে তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায়। এসব করতে গিয়ে বরগুনায় নতুন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে তারা। এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রমের এলাকাভিত্তিক নেতৃত্বে রয়েছে সানী, সোহেল ও অভিসহ আরও কয়েকজন। এই উঠতি সন্ত্রাসী মাদকচক্রকে শেল্টার দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা। যারা স্থানীয় পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে স্থানীয়রা আরও জানিয়েছেন, স্থানীয় পুলিশের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক মদদের কারণে বরগুনায় উঠতি সন্ত্রাসী বা কিশোর গ্যাং হয়ে উঠেছে আরও বেপরোয়া ও ভয়ঙ্কর। ধারাবাহিকভাবে তারা একের পর এক নির্মম-নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। আলোচিত রিফাত শরীফের মতো করে গত ২৭ মে হৃদয় নামে এক যুবককে প্রকাশ্যেই নির্মমভাবে ধাওয়া করে পিটিয়ে হত্যা করে আরেক নয়ন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। তবে এ ঘটনাটি রিফাত হত্যাকাণ্ডের মতো এতটা আলোচিত হয়নি। আর তাই জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতেও দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আমাদের রুটিন ওয়ার্কগুলো করছি। কিশোর গ্যাং বা উঠতি সন্ত্রাসী গ্রুপের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে। নতুন করে কেউ যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সে লক্ষে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।’
বরগুনার স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বরগুনায় সানী নামে একজন উঠতি যুবকের নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালিত হচ্ছে। বরগুনা শহরের চরকলোনি, স্টেডিয়াম, কড়ইতলা ও বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ড এলাকার নিয়ন্ত্রণ এই সানীর হাতে। তার নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের বয়স ২০ বছরের নিছে। এই কিশোর গ্রুপটিও ওইসব এলাকায় এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। তবে গত ২ অক্টোবর বরগুনা শহর থেকে পুলিশ ৫০ পিস ইয়াবাসহ এই সানীকে গ্রেফতার করে। এখানেই শেষ নয়, সানীর ছোটভাই জাহিদের নেতৃত্বে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা পুলিশের গাড়ি অবরোধ করে সানীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিশ সেখান থেকেও কয়েকজনকে আটক করেছে বলে জানা যায়।
এদিকে দক্ষিণ বরগুনার খাড়াকান্দা, বাঁশবুনিয়া ও কালিতবক এলাকায় আধিপত্য, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার পরিচালনাসহ একটি উঠতি সন্ত্রাসী গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় তাঁতী লীগের নেতা সোহেল। বরগুনায় তাঁতের তেমন কোনো কারবার না থাকলেও তাঁতী লীগ নেতা সোহেল রাজনৈতিক খোলসে জেলার একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলের ছত্রছায়ায় ইয়াবা কারবারসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সোহেলের গ্রুপেও প্রায় ৫০ জন সদস্য রয়েছে। এরা চার থেকে পাঁচজনে ভাগ হয়ে বিভিন্ন মিশন পরিচালনা করে থাকে বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া বরগুনার কলেজ রোড, ব্রাঞ্চ রোড, আমতলা, কাঠপট্টিসহ আশপাশের এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে অভিজিৎ তালুকদার অভি নামে আরেকজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পুলিশ ও স্থানীয়দের তথ্যমতে অভি অস্ত্র, মাদক, ছিনতাইসহ বিভিন্ন মামলায় একাধিকবার জেলও খেটেছে। কিন্তু নেপথ্যে জেলার প্রভাবশালীদের মদদ থাকায় বারবার সহজেই ছাড়া পেয়ে যায় সে। অভি মূলত পুরো বরগুনাজুড়েই বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এই গ্রুপের কাজ স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য সৃষ্টির মাধ্যমে নির্বিঘ্নে মাদক কারবার পরিচালনা করা। এর বাইরেও বরগুনায় ছোট ছোট কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করছে আরও কয়েকজন। তাদের মধ্যে শহরের টাউন হল এলাকায় সরল আহমেদ, ক্রোক এলাকায় আল আমিন ও মামুন মন্টু, কালীবাড়ি এলাকায় আবিদ মুন্না, পশু হাসপাতাল এলাকায় জনি, কাঠপট্টি এলাকায় মিরাজ সিকদার, লাকুড়তলায় (মাছবাজার সংলগ্ন ব্রিজের পাশে) রুহুল, কেজি স্কুল এলাকায় রিমন এবং খাড়াকান্দা ও বাজার এলাকায় মঞ্জুরুল ইসলাম জনের গ্রুপের দৌরাত্ম্য রয়েছে বলে স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, গত ২৫ মে বিকালে গোলবুনিয়ায় পায়রা নদীর পাড়ের ব্লক ইয়ার্ডে শত শত তরুণ-তরুণী ঘুরতে যায়। ওইদিন বিকালে বরগুনা সদরের হৃদয় তার বেশ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে সেখানে ঘুরতে যায়। এ সময় হৃদয়ের এক বান্ধবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তারা কথা বলছিল। তখন হৃদয় এবং তার বান্ধবীকে নিয়ে স্থানীয় বখাটে সন্ত্রাসী নয়ন ও তার সহযোগীরা বাজে মন্তব্য করে। এর প্রতিবাদ করে হৃদয়। কিছুক্ষণ পরেই উত্ত্যক্তকারী নয়ন, হেলাল, আবীর, তনিক এবং নোমানসহ তাদের সহযোগীরা লাঠিসোটা নিয়ে হৃদয়ের ওপর হামলা চালায়। এ সময় হৃদয় দৌড়ে বাঁচতে চাইলেও তাকে তাড়া করে পেটাতে থাকে নয়ন, হেলাল এবং নোমানসহ তাদের সহযোগীরা। একপর্যায়ে লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে হৃদয়। কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। পরে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় হৃদয়।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, বরগুনা শহর ও বিভিন্ন এলাকা থেকে তরুণ-তরুণীরা সদর থানাধীন গোলবুনিয়া ব্লক ইয়ার্ডে ঘুরতে গেলে স্থানীয় নোমান, হেলাল, নয়ন, আবীর এবং তনিকসহ তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন সময়ে তাদের উত্ত্যক্ত ও অপমান করত। তারই ধারাবাহিকতায় হৃদয় হত্যার ঘটনা ঘটে। এ হত্যার ঘটনায় পুলিশ মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করে। তার মধ্যে পাঁচজন ইতোমধ্যেই জামিনে মুক্ত হয়েছে। বাকি চারজন এখনও কারাগারে আছে।
মূলত রিফাত হত্যার পর থেকে দেশে কিশোর গ্যাংয়ের ভয়াবহতা সবাইকে ভাবিয়ে তোলে। অথচ সেই বরগুনায় এখনও এলাকাভিত্তিক ত্রাস সৃষ্টি করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং বা উঠতি সন্ত্রাসী গ্রুপ।’