বরিশাল সদর
বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে-নৌপুলিশের এসি মোঃ তোফাজ্জেল হোসেন
নদীতেই নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের জমজমাট বেচা-বিক্রি
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল সদরের অধিকাংশ নদীতেই বেচা-বিক্রি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জব্দকৃত নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল। ২০০২ সালে সংশোধিত মৎস্য সংরক্ষণ আইনে কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বছর জুড়ে মাঝি ও নৌপুলিশের মাসতুতো ভাই সর্ম্পকে বাস্তবে মানা হচ্ছে না এই আইন।
মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কারেন্ট জাল আটক এবং সংশ্লিষ্ট জেলেদের মোটা অঙ্কের অর্থ জরিমানার খবর আমরা শুনতে পাই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জব্দকৃত কারেন্ট জালের সিংহভাগই নৌপুলিশ ও মাঝিরা নদীতেই জেলেদের কাছে ফের বিক্রি করে দেয়। আর এ প্রক্রিয়ায় কমপক্ষে কোটি টাকার বিকিকিনি হয় ৪/৫ টি স্পটে। তবে এই কালোবাজারিতে স্থানীয় মাঝি ও জেলেদের যোগসাজশে পোয়াবারো নৌপুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
এ নিয়ে অনুসন্ধানসূত্রে জানা গেছে, জেলেদের থেকে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল জব্দ কারার অভিযানে মাঝিদের নেয়া হয় নদীপথ পরিচিতি ও ট্রলার চালানোর জন্য। প্রত্যেক মাঝি সপ্তাহে একবার করে মাসে চারবার ডিউটি পায়। নৌপুলিশের এই ডিউটি পাবার জন্য প্রত্যেক মাঝিকে ৫/১০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।
অভিযানে মাঝিদের ডিউটি নিতে ঘুষ দেয়ার কারন হিসেবে জানা গেছে, অভিযানে জব্দকৃত কারেন্ট জালের বেশিরভাগই বিক্রি করা হয় ওই মাঝিদের মাঝে। আর মাঝিরা জব্দকৃত জাল বাজারদরের চেয়ে অর্ধেকের কম দামে কিনে নেয় নৌপুলিশের আভিযানিক দলের কাছ থেকে। এরপর জব্দকৃত ওই জাল ফের বিক্রি করা হয় জেলেদের কাছে। বাজার দরের চেয়ে কমদামে কিনতে পারায় জেলেরাও গোপনে ওই মাঝিদের কাছ থেকে জাল কিনে নেয়।
তবে এ ব্যাপারে বরিশাল নৌপুলিশের এসি মোঃ তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। এখন যেহেতু বিষয়টি জানতে পেরেছি সেক্ষেত্রে আমরা সিনিয়র অফিসাররা বসে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবো। এ ধরণের কর্মকান্ড কারনে কারেন্ট জাল নিষিদ্ধ হলেও তা বাস্তবে রূপ দেয়া অসম্ভব হয়ে উঠবে। এসময় তিনি আরো বলেন, নদীতে জেলেরা যাতে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ব্যবহার করতে না পারে সেলক্ষ্যে আমাদের নিয়মিত অভিযান চালু রয়েছে।
বরিশাল সদর এলাকায় চরমোনাই, লাহারহাট, কালিজিরাসহ অন্তত চারটি স্পটে জেলেরা নিয়মিত কারেন্ট জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করছে। এই এলাকাগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই শতাধিক জেলে তাদের নৌকা ও ট্রলার নিয়ে প্রায় ২৪ ঘন্টাই মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করে। জব্দকৃত কারেন্ট জাল পুনুরায় বিকিকিনির চক্রের সাথে রয়েছে কাউয়ারচর এলাকার মাঝি রফিক, লাহারহাটের রাজু ও সোহরাব।
এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, রফিকের বাসায় এবং ওদের বাড়ির আশে পাশেও অনেক কারেন্ট জাল মজুদ করা আছে। এছাড়াও নদী ও পুকুরে অথবা ডোবার মধ্যে বস্তা ভর্তি কারেন্ট জাল ইট দিয়ে ডুবিয়ে রাখা হয় গোপনে। এরপর চাহিদামতো বিক্রি করা হয় নিষিদ্ধ ও জব্দকৃত এ কারেন্ট জাল। এরপর ক্রয়কৃত কারেন্ট জাল রাতে নৌকাযোগে জেলেরা নিজ নিজ সুবিধামতো স্থানে নিয়ে যায়।
এদিকে নিষিদ্ধ ও জব্দকৃত কারেন্ট জাল কালোবাজারিতে বিক্রির হোতা রফিক বলেন, আমি এখন এগুলো করিনা। আগে যে স্যারেরা (নৌপুলিশ সদস্য) করতো তারা কে কোথায় আছে তা ও আমি জানি না। এসময় তিনি আরো বলেন, স্যারদের সাথে ডিউটি করলে তৈল ও খাওয়া-দাওয়ার বাজার সদায় করে প্রায় ১০/২০ হাজার টাকা খরচা হয়ে যায়।
শুধু তাই নয়, ডিউট পাওয়ার জন্য আবার স্যারদেরকে ঘুষ দিতে হয়। সপ্তাহে একটা এবং মাসে চারটা ডিউটি পাইতাম। আগে স্যারেরা নদীতে যে জাল ধরতো তা ওখানে বসেই দাম ধরে স্যারদের টাকা দিয়ে দেতাম। আর জব্দকৃত ওই সকল কেনা জাল নিজেদের গোপন জায়গায় সরিয়ে রাখতাম। এভাবে এক মাসে ৩/৪ লাখ টাকার জাল কিনলে আমাদের প্রায় ৫০ হাজার টাকা লাভ হতো। দৃষ্টি আড়াল করতেই মাঝি রফিকের ছিল এমন সরল উক্তি।
তবে সরোজমিন সূত্র ও রফিকের এলাকার একাধিক প্রতিবেশি জানায়, মূলত রফিকই জব্দকৃত জাল কালোবাজারে বিক্রির বড় বিনিয়োগকারী। অথচ তার বেশভূষা ও বাড়ির অবস্থা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে জব্দকৃত কারেন্ট জাল বিকিকিনির বড় এক হোতা। তার বাসায় দু’বস্তা কারেন্ট জাল দেখে জানতে চাওয়া হলে রফিকের স্ত্রী তেরে এসে বলে, এই জাল আমরা কিনেছি ক্ষেতে বেড়া দেয়ার জন্য। কিন্তু কোথা থেকে কেনা হয়েছে জানতে চাইলে ফের তেড়ে এসে বলে আমরা সাংবাদিক গো হ্যা কমু, ঠেকছি কিসে।
মাঝি রফিকের স্ত্রীর এমন আক্রমণাত্মক চরিত্রের বিষয়ে একাধিক সূত্র জানায়, রফিক ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ওর স্ত্রীকে দিয়ে জাল বিকিকিনির কাজটা সেরে নেয় লোকচক্ষু আড়াল করতে।