বরিশাল
নগরীজুড়ে নতুন মাদক ‘উইন কোরেক্স’ আতঙ্ক
- নতুন নামে পুরোনো নেশা
- ফেনসিডিলের শূন্যস্থান দখলে নতুন কৌশল
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল নগরীতে নতুন এক ধরনের মাদক ‘উইন কোরেক্স’ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ বাড়ছে নগরবাসীর মধ্যে। মাদকসেবীদের কাছে এটি ‘জয়ন্তী’ নামেও পরিচিত। মূলত শুষ্ক কাশির চিকিৎসায় ব্যবহৃত এই সিরাপটি এখন ফেনসিডিলের বিকল্প মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নেশা দ্রুত হওয়া এবং তুলনামূলক কম দামের কারণে অল্প সময়েই এটি মাদকসেবীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফেনসিডিলের সরবরাহ কমে যাওয়ার পর সেই শূন্যস্থান পূরণ করতেই পরিকল্পিতভাবে বাজারে আনা হয়েছে ‘উইন কোরেক্স’। নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড, অলিগলি, বাস টার্মিনাল, নদীবন্দর সংলগ্ন এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী উপজেলাগুলোতে এই মাদক এখন প্রকাশ্যেই হাতবদল হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আগে যারা ফেনসিডিলের কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাই কৌশল বদলে এই নতুন মাদক পুরো নগরী ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বাংলাদেশে তুলনামূলক কম পরিচিত হওয়ায় ‘উইন কোরেক্স’কে কাশির সিরাপ হিসেবে প্রচার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে ওষুধের চালানের আড়ালে এসব সিরাপ দেশে ঢুকছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যই এই ‘উইন কোরেক্স’ মাদকের প্রকৃতি, উপাদান ও অপব্যবহার সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখেন না। এই সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে মাদক কারবারিরা। ফলে নির্বিঘেœ চলতে পারছে এই নতুন মাদক ব্যবসা। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যেও রয়েছে বিভ্রান্তি।
বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. তানভীর হোসেন খান বলেন, “ফেনসিডিল ও ‘উইন কোরেক্স’ মূলত একই জিনিস কি না সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে নেই। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মাদকের উপস্থিতি আছে কি না যাচাই করে শিগগিরই বিস্তারিত জানানো যাবে।”
অন্যদিকে মহানগর গোয়েন্দা শাখার পুলিশ পরিদর্শক মো. ছগির হোসেন জানান, ফেনসিডিল ও ‘উইন কোরেক্স’ কার্যত একই শ্রেণির মাদক। তিনি বলেন, “দুটিতেই কোডিন ফসফেট রয়েছে, যা অবৈধ মাদকদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত। ইতোমধ্যে আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি এবং শিগগিরই ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হবে।” তিনি আরও জানান, গত ২১ ডিসেম্বর ‘রাজু’ নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ৬ পিচ নতুন এই মাদক ‘উইন কোরেক্স’ সহ আটক করা হয়েছে।
সূত্রমতে, ভারতের সীমান্তঘেঁষা অন্তত ১০ জেলার কারখানায় তৈরি এসব কোডিন ফসফেটযুক্ত সিরাপ বাংলাদেশের আটটি সীমান্ত জেলা দিয়ে ঢুকছে। ইতোমধ্যে ছোট কয়েকটি চালান আটকও হয়েছে। তবে নতুন হওয়ায় এই সিরাপ এখনো পুরোপুরি শনাক্ত তালিকায় না থাকায় তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে ভারতীয় মাদক কারবারিরা বড় বড় চালান বাংলাদেশে পাঠানোর ছক কষছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোডিন ফসফেটযুক্ত এই মাদক সেবনের পর দ্রুত নেশা সৃষ্টি হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি মারাত্মক। অল্প খরচে সহজলভ্য হওয়ায় নগরীর কিশোর ও তরুণদের একটি অংশ দ্রুত এই মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে অভিভাবক ও সচেতন মহল আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পরিচালক ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, “মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও বাংলাদেশে নানা ধরনের মাদক ঢুকে পড়ছে। ওষুধের আড়ালে নতুন নামে মাদক প্রবেশ করলে তা আরও ভয়ংকর। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি সংস্থাকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। তা না হলে তরুণ সমাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার পরিণতি দেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।”
মাদকবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি, দ্রুত ‘উইন কোরেক্স’ বা ‘জয়ন্তী’কে আনুষ্ঠানিকভাবে শনাক্ত করে আইনি আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। তা না হলে বরিশালে এই নতুন মাদক অচিরেই একটি ভয়াবহ সামাজিক সংকটে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট মহলের।



