বরগুনা
চারটি বাঁশের সাঁকো সংস্কারে ৯ কোটি টাকা বরাদ্দ
বরগুনা প্রতিনিধি।। লোহার ব্রিজ সংস্কার করার কথা থাকলেও চারটি বাঁশের সাঁকো সংস্কারে ৯ কোটি টাকা ব্যয় দেখিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আয়রন ব্রিজ পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের (আইবিআরপি) আওতায় গত ২৮ জুলাই ৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় ৩৩টি লোহার ব্রিজ সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করে জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। দরপত্রে আমতলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ২৬টি ও তালতলী উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে সাতটি ব্রিজ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ অনুমোদন দেয়া হয়। মোট আটটি প্যাকেজে আহ্বান করা হয় এ দরপত্র। দরপত্র জমাদানের শেষ তারিখ বেধে দেয়া হয়েছে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। দরপত্রে পুরোনো ব্রিজের স্থলেই কেবলমাত্র সংস্কারে জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ব্রিজ নেই এমন কোথাও নতুন করে ব্রিজ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
বরগুনার আমতলী উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের তুজির বাজার। এই বাজার সংলগ্ন খালের উপর তিন কোটি টাকারও বেশি ব্যয়ে ৮৫ মিটার দৈর্ঘ্যের (২৭৮.৮৮ ফুট) একটি লোহার ব্রিজ সংস্কার করার কথা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি)। গত শুক্রবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত ওই ব্রিজটি তন্নতন্ন করেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে একটি বাঁশের সাঁকো পাওয়া গেছে। এ নিয়ে কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক মোল্লার (৬৫) সঙ্গে। এখানে ব্রিজ আছে কি-না জানতে চাইলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন তিনি। আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা বলেন, এখানে ব্রিজ পাবেন কই? দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যেও এখানে কোনো ব্রিজ নেই। যুগ যুগ ধরে কত জনপ্রতিনিধির, কত অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি আমরা। কিন্তু কেউ এখানে একটি ব্রিজ দেয়নি। প্রতিদিন শত শত গ্রামবাসী বাঁশের সাঁকো দিয়েই এই খাল পার হয়। নিজেদের উদ্যোগে এই সাঁকো তৈরি করেছি আমরা। ওই যে বাঁশের সাঁকো দেখছেন, ওটাই এখানকার ব্রিজ। এখানে একটি ব্রিজ আছে এবং সেই ব্রিজটি সংস্কারে তিন কোটি টাকারও বেশি প্রাক্কলন ব্যয় ধরে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে জেনে স্থানীয় যুবক মো. সজীব (২৫) বলেন, দেশটা চোরে ভরে গেছে। এই সাঁকোটিকেই কাগজে-কলমে ব্রিজ বানিয়ে সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এখানকার সংসদ সদস্য ছিলেন। এই লুটপাটের খবর তিনি যদি জানতে পারেন, তাহলে একটা ব্যবস্থা হবেই।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, দরপত্রের অন্তর্ভুক্ত হলদিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ তক্তাবুনিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন নাশবুনিয়া খালের উপর চার কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে সংস্কারের আওতায় আনা ২ নম্বর প্যাকেজে থাকা ১১০ মিটার (৩৬০ ফুট) দৈর্ঘ্যের ব্রিজ তো দূরের কথা খালেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি। এমনকি উপজেলার কোথাও এই নামে কোনো খাল নেই বলেও নিশ্চিত করেছেন উপজেলার নবীন-প্রবীণ অধিবাসী এবং সাবেক জনপ্রতিনিধিসহ বর্তমান জনপ্রতিনিধিরাও। এছাড়াও আড়াই কোটি টাকার অধিক ব্যয়ে দরপত্রের ৩ নম্বর প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত একই ইউনিয়নের রামজি বাজার সংলগ্ন ৭০ মিটার (২২৯ ফুট) দৈর্ঘ্যের একটি ব্রিজ সংস্কারের কথা বলা হলেও সেখানে স্থানীয়দের উদ্যোগে নির্মিত একটি বাঁশের সাঁকো ছাড়া কোনো ব্রিজ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রকল্পের ৪নং ও ৫নং প্যাকেজের আওতায় গুলিশাখালী ইউনিয়নের ডালাচরার একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাত কিলোমিটার এলাকায় ছয়টি ব্রিজ সংস্কারে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সেখানে ৭০০০ মিটারের শরীফ বাড়ি সংলগ্ন একটি ব্রিজ দেখানো হয়েছে। কিন্তু শরীফ বাড়ি সংলগ্ন এলাকায় কোনো ব্রিজ নেই। সেখানে বাঁশের সাঁকো রয়েছে।
এদিকে, হলদিয়া ইউনিয়নের তুজির বাজার সংলগ্ন ৮৫ মিটার দৈর্ঘ্য যে ব্রিজটি সংস্কারের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, সেখানে থাকা বাঁশের সাঁকোটির দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৬০ মিটার। ব্রিজ না থাকার পরও এখানে ২৫ মিটার দৈর্ঘ্য বেশি দেখানো হয়েছে। এছাড়াও এখানে মাটির কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় নয় লাখ টাকা। একই ইউনিয়নের রামজী বাজার সংলগ্ন ব্রিজেরও একই অবস্থা। সেখানেও ব্রিজ নেই। আছে ৫১ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি বাঁশের সাঁকো। অথচ এখানেও এই ব্রিজের দৈর্ঘ্য ১৯ মিটার বেশি দেখানো হয়েছে। ব্রিজই নেই অথচ সংস্কারের নামে কোটি কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় দেখিয়ে দরপত্র আহ্বান করায় এ প্রকল্পটিকে ভুয়া ও ভৌতিক প্রকল্পের পাশাপাশি লুটপাটের প্রকল্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়াও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না করে স্থগিত করার জন্য সংবাদ সম্মেলন এবং মানববন্ধনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরে দৌড়ঝাঁপও শুরু করেছেন ঠিকাদাররা।
এদিকে ভুয়া ও ভৌতিক এই দরপত্রটি বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যেই এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছেন বরগুনার ঠিকাদাররা। ওই চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের মন্ত্রী ও সচিবকেও। চিঠিতে প্রয়োজনের তুলনায় প্রকল্পের প্রাক্কলন ব্যয় দ্বিগুন করার পাশাপাশি দরপরত্রটি বাতিলের যৌক্তিকতাও তুলে ধারা হয়েছে। এছাড়াও একই পদ্ধতিতে বিএনপি জোট সরকারের সময়ে এমন প্রকল্পের মাধ্যমে একটি চক্র কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছে বলেও উল্লেখ রয়েছে ওই চিঠিতে। কোনো সুনির্দিষ্ট ঠিকারদারকে এই কাজ পাইয়ে দিতে এমন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঠিকাদার মো. বশির উদ্দিন বলেন, দরপত্র আহ্বান করার পর আমতলী উপজেলার অন্তত ২৫টি ব্রিজ আমরা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। এর মধ্যে ১৩টি ব্রিজের স্থানে আমরা বাঁশের সাঁকো পেয়েছি। আর এমন কয়েকটি ব্রিজ দেখেছি- বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে ওইসব ব্রিজ সংস্কারের কোনো প্রয়োজনই নেই। প্রতিটি ব্রিজের দৈর্ঘ্যই বেশি দেখানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
নিয়মানুসারে প্রাক্কলন তৈরির ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সার্ভেয়ার (পরিমাপক) ব্রিজ পরিমাপ করবেন। এছাড়াও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সরেজমিনে পরিদর্শনের পর প্রাক্কলন তৈরি করার কথা। যোগাযোগ করা হলে আমতলী উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সার্ভেয়ার আবদুল কুদ্দুস বলেন, ব্রিজের দৈর্ঘ্য ও মাটি পরিমাপের কথা থাকলেও আমি কিছুই করিনি। প্রাক্কলন তৈরির পর আমাকে স্বাক্ষরের জন্য বলা হলেও আমি সরেজমিনে পরিদর্শন না করে স্বাক্ষর করবো না বলে জানিয়ে দেই। পরবর্তীতে কীভাবে প্রাক্কলন অনুমোদন করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। একই বক্তব্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিজাম উদ্দীনের। তিনি বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেয়ার পর প্রাক্কলন তৈরির নিয়ম থাকলেও আমি এসবের কিছুই করিনি। ঢাকা থেকেই প্রাক্কলন তৈরি ও অনুমোদন করা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না। বরগুনা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী ফোরকান আহমেদ খান বলেন, এই প্রকল্পের প্রাক্কলন তৈরি থেকে শুরু করে কোনো কাজেই জেলা পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট নেই। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর অনুমোদনক্রমে সব কিছুই প্রকল্প পরিচালক নির্ধারণ করেছেন। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র নির্দেশনা অনুসরণকারী মাত্র।
এ বিষয়ে আইবিআরপি প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল হাই বলেন, এ বিষয়ে আমি নিজেও জানি না। বরগুনা থেকে প্রাক্কলন পাঠানো হয়েছে এবং তা অনুমোদন করা হয়েছে। আমার মনে হয় এতো বড় ভুল হওয়ার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যেই আমরা সরেজমিনে তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করেছি। অভিযোগের সত্যতা পেলে দরপত্র বাতিল করা হবে।