বরিশাল
ক্যানসার দমাতে পারেনি মাহাথিরকে, হতে চায় মানবিক চিকিৎসক
দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করার পরও দমানো যায়নি বরিশাল জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী মাহাথির রহমানকে। এ বছর সে প্রতিটি বিষয়ে জিপিএ-৫ (গোল্ডেন) নিয়ে পাস করেছে। ভবিষ্যতে ক্যানসারের মানবিক চিকিৎসক হতে চায় মাহাথির। আর তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছেন তার মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজন।
মাহাথিরের বাবা প্রবাসী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ আবুধাবিতে কর্মরত ছিলাম। যমজ দুই ছেলে মাহাথির রহমান ও মাকতুম রহমান বরিশাল নগরীর মুন্সি গ্যারেজ এলাকায় তাদের মায়ের কাছে থাকতো। ২০১৮ সালের দিকে মাহাথির তার মায়ের সঙ্গে বাজারে যায়। এ সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বরিশালের চিকিৎসক নানা ধরনের পরীক্ষা শেষে তাকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। পরে আমাদের এক চিকিৎসক আত্মীয়ের শরণাপন্ন হই। সেখান থেকেও একই ফলাফল আসে। তার বোন ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছেলের ক্যানসারের বিষয়টি জানার পর বিদেশে বসে একদম ভেঙে পড়ি। এরপর দেশে ফিরে এসে ছেলেকে নিয়ে যাই ভারতে। সেখানে চলে দীর্ঘ ছয় মাসের চিকিৎসা।’
মফিজুর রহমান জানান, ছোটবেলা থেকেই মাহাথিরের লেখাপড়ায় ঝোঁক ছিল। একই অবস্থা ছিল তার অপর যমজ ভাইয়েরও। অসুস্থ হওয়ার পরও সে কোনোভাবেই লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যায়নি মাহাথির। সুস্থতা অনুভব করলেই বই নিয়ে বসে পড়তে। লেখাপড়ার জন্য কোনোভাবে তাকে জোর করা হতো না। এভাবে দীর্ঘ ৫ বছর মাহাথিরকে ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এরপর বোন মেরু ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। প্রতিদিন ১০-১২টি বিভিন্ন ওষুধ খেতে হয়। তা ছাড়া দীর্ঘ চিকিৎসায় তাকে অর্ধশতাধিক কেমো দিতে হয়েছে। খাবারের প্রতি সামান্যতম আসক্তি ছিল না। এভাবে চলতে থাকায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিদেশে যাওয়া আর হয়নি তার। তবে এখন ক্যানসারের জীবাণুমুক্ত মাহাথির।
মাহাথিরের বাবা বলেন, ‘অসুস্থ শরীর নিয়ে ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে পরীক্ষা থেকে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু সুস্থতা অনুভব করলেই মাহাথির বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতো। তখন তাকে নিষেধ করলেও শুনতো না। তার কথা ছিল, আমি এখন সুস্থ আছি কিছু লেখাপড়া করে এগিয়ে থাকি। এভাবে চলতে থাকার পর ২০২৪ সালের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মাহাথির। তার জন্য বাসায় শিক্ষক রাখা হয়। তারাও জানিয়েছেন, মাহাথির অনেক মেধাবী। সে ভালো ফলাফল করবে। এভাবে সব বিষয় জিপিএ-৫ নিয়ে পাস করবে তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল।’
মাহাথিরের যমজ ভাই মাকতুম রহমান বলেন, ‘যমজ হওয়ায় আমরা দুই ভাই একসঙ্গে প্রতিটি ক্লাসে পড়েছি। ভালো ফলাফল করতাম আমরা। কিন্তু মাহাথির অসুস্থ হয়ে পড়লে তার প্রভাব আমার ওপর পড়ে। কারণ, বেশির ভাগ সময় মা-বাবা মাহাথিরকে নিয়ে ঢাকা ও ভারতে অবস্থান করতেন। ওই সময় আমাকে আত্মীয়স্বজনের কাছে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এরপরও লেখাপড়া থেকে সরে যাইনি। ২০২২ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এবার সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবো। আমার ইচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হবো। একই সঙ্গে মাহাথিরের চিকিৎসক হওয়ার আশা পূরণ হবে বলেও আশাবাদী। মাহাথির আমার চেয়েও অনেক মেধাবী। কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও মাহাথির তার লক্ষ্য পূরণ করবেই।’
মাহাথিরের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, ’আমার যমজ দুই ছেলেই মেধাবী। তারা বেশির ভাগ সময় পড়ালেখায় কাটায়। পড়ার জন্য তাদের বলতে হয় না। মাহাথির চিকিৎসাধীন অবস্থায় বই নিয়ে পড়াশুনা করতো। তার শরীর ভালো থাকলেই কোনোভাবে তাকে আটকানো যেতো না। আর এ কারণেই এসএসসিতে ভালো ফল করেছে। ছোটবেলা থেকেই মাহাথির বলতো, সে ডাক্তার হবে। অসুস্থ হওয়ার পর সেই আবেগটা তার মধ্যে বেশি কাজ করেছে। কারণ, ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে কষ্টটা অনুভব করতে পেরেছে সে। এ কারণে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হতে চায় মাহাথির। আমাদেরও ইচ্ছে, মাহাথির তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিক। একই সঙ্গে একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। এজন্য মা-বাবা হিসেবে আমরা দুজন সর্বাত্মক তার পাশে থাকবো।’