কলাপাড়া
কুয়াকাটায় এসে মারা গেল তিমি
নিজস্ব প্রতিবেদক॥ পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সাগর মোহনায় এবার ভেসে এলো জীবিত তিমি। সৈকতের পশ্চিমে লেম্বুর চরসংলগ্ন শিববাড়িয়া নদীর মোহনায় রোববার সকাল পৌনে ৮টার সময় সাড়ে আট ফুট লম্বা জীবিত তিমিটি প্রথমে স্থানীয়রা দেখতে পান।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই এটি মারা যায়। এটি ‘কগিয়া সিমা তিমি’ (ড্রফ স্পার্ম হোয়েল) বলে নিশ্চিত করেছেন জেলা ইউএস-এইড/ইকো-ফিশ-২, ওয়ার্ড ফিশ বাংলাদেশ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি। তিনি দুই বছর ধরে কুয়াকাটায় ডলফিন নিয়ে গবেষণা করছেন।
তিনি বলেন, ‘আজ ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দিবস। এই দিনে এমন একটি ঘটনায় আমরা সবাই ব্যথিত। আমরা একটি জীবিত প্রাণীকে বাঁচাতে পারলাম না। বিষয়টি আমাকে মর্মাহত করেছে।’
সাগরিকা স্মৃতি বলেন, ‘এটি আমাদের এই অঞ্চলে নতুন প্রজাতি। এটি বিশ্বব্যাপী নাতিশীতষ্ণ এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় মহাসাগরে বসবাস করে, বিশেষ করে মহাদেশীয় তাক এবং ঢালে।’
সাগরিকার ধারণা, সাগরে ৬৫ দিনের অবরোধ চলায় নির্বিঘ্নে উপকূলের মোহনায় চলে আসে তিমিটি। এটির শরীরে কয়েকটি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিশেষ করে মাথা এবং লেজে জাল প্যাঁচানো ছিল। একপর্যায়ে কিনারায় এসে এটি বালুর মধ্যে আটকে পড়ে।
সাগরিকা বলেন, ‘আমরা মৃত তিমিটিকে মহিপুর-আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি। প্রাণীটিকে দেখিয়ে জেলেদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। কিছু স্যাম্পল সংগ্রহ করার জন্য রেখেছি। পরবর্তী সময়ে মৎস্য বিভাগ, ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের নির্দেশক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য আবুল হোসেন রাজু বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আমরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিমিটি মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। পরে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এর মুখ ও পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছে। এটি লম্বায় সাড়ে আট ফুট হবে। এর পাখনা ও লেজে জাল প্যাঁচানো ছিল এবং ওই স্থানেই আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।
‘আমরা এসে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় এটিকে ট্রলারে তুলে মহিপুরে নিয়ে যাই এবং স্থানীয় জেলেদের সামনে রাখা হয়। জেলেদের এটি দেখিয়ে আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করছি।’
রাজু জানান, কয়েক বছর ধরে একাধিক মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে আসছে। যার মধ্যে অর্ধগলিত বা গলিত অবস্থায়ও আমরা দেখতে পেয়েছি। কিন্তু জীবিত তিমি এই প্রথমবারের মতো ভেসে এলো কুয়াকাটায়।
রাজু বলেন, ‘ডলফিন নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যাচ্ছি যে কেন ডলফিন মারা যাচ্ছে এবং তিমিসহ এ-জাতীয় প্রাণী কেন উপকূলে এসে মারা যাচ্ছে। এ থেকে বাঁচতে আমাদের করণী কী, স্থানীয় জেলেদের করণীয় কী সেসব বিষয় নিয়েই মূলত আমরা জেলেদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। মাছ ধরার সময় জালে ডলফিন বা তিমিসহ অন্য কোনো প্রাণী আটকে গেলে সেটিকে যেন কেউ আঘাত না করি। প্রাথমিকভাবে আমরা এ বিষয়টির ওপর বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি।’
তিমিটি যখন ভেসে আসে, তখন মোহনায় ছিলেন ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের চালক কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সকাল পৌনে ৮টার দিকে পর্যটক নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে লেম্বুর চরে যাই। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই মোহনায় একটি ডলফিনজাতীয় প্রাণী ছটফট করছে। বিষয়টি দেখে আমার সন্দেহ হয়েছে। পরে ধীরে ধীরে সেটির কাছাকাছি গেলে দেখতে পাই তার শরীর থেকে রক্ত বের হচ্ছে এবং পেট ফেটে খাবার বের হচ্ছে।
‘তখন আমি মনে করেছি, এটি মনে হয় বালুতে আটকা পড়েছে তাই আমার আরও কয়েকজন সহকর্মীর সহায়তায় সেটিকে ঠেলে সামান্য দূরে পানির মধ্যে সরিয়ে দিই। কিন্তু সেখানেও সে লাফালাফি করছিল। এ রকম প্রায় ৩০-৪০ মিনিট পর্যন্ত ছটফট করার পর সেটি মারা যায়। পরে ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্যদের কাছে খবরটি জানিয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি।’
কামাল বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় দেখার সময় প্রাণীটির শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। আমার মনে হয় প্রাণীটি পেটের ব্যথায় অস্থির হয়ে তীরে চলে আসছে।’
বন বিভাগের মহীপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা সেটিকে মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। পাশাপাশি স্যাম্পল সংগ্রহ করে রেখেছি, যা পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।’
এ বছর এখন পর্যন্ত ১২টি মৃত ডলফিন কুয়াকাটা সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে এসেছে। এ ছাড়া অনেকগুলো জীবিত ও মৃত কচ্ছপও ভেসে আসছে। এর আগে হাজার হাজার মৃত জেলি ফিশও সৈকতের বালুতে আটকে পড়েছিল।