পিরোজপুর
পিরোজপুরে সংকটে ডকইয়ার্ড শিল্প, কর্মহীন আড়াই হাজার শ্রমিক
পিরোজপুরের নেছারাবাদে এক সময়ের ব্যস্ততম নৌযান নির্মাণ কেন্দ্রগুলোতে এখন নীরবতা। ছোট-বড় মিলিয়ে ৩০টি ডকইয়ার্ডের মধ্যে গত দুই বছরে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ৭টি। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই ডকগুলোর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো শ্রমিকের স্বপ্ন। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় আড়াই হাজার দক্ষ শ্রমিক। সংকটে রয়েছে বাকি ডকইয়ার্ডগুলোও।
বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের ২৭ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত নেছারাবাদ উপজেলার দুই পাশে বয়ে চলেছে সন্ধ্যা নদী। নদী ঘেঁষেই গড়ে ওঠে ছারছিনা, নান্দুহার, কালীবাড়ি, বালিহারী, মাগুরাসহ আশপাশের গ্রামগুলোর ডকইয়ার্ডগুলো। ৩৫ বছর আগে বরছাকাঠির আবদুল বারেক ও রুস্তম আলীর হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় এই শিল্পের।
তখন থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে প্রায় ৩০টিরও বেশি ডকইয়ার্ড। এই ডকইয়ার্ডগুলোতে বছরে তৈরি হতো প্রায় ২০০টি নৌযান। মেরামত করা হতো আরও দেড় থেকে দুই হাজার নৌযান। এখানে ৫০ লাখ থেকে শুরু করে ১০ কোটি টাকা মূল্যের জাহাজ নির্মাণ হতো, যার মধ্যে ছিল লঞ্চ, উন্নতমানের ট্রলার ও বড় আকারের কার্গো জাহাজ। ২০০ থেকে ২৫০ ফুট দীর্ঘ নৌযান নির্মাণে সময় লাগতো প্রায় ৯-১০ মাস।
তবে করোনাভাইরাস মহামারির পর থেকেই হঠাৎ থমকে যায় এই শিল্পের চাকা। মহামারির পর থেকে নৌযান নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের দামের বৃদ্ধি এবং সড়ক ও রেলপথে পরিবহনের ওপর নির্ভরতা বাড়ার ফলে ডকইয়ার্ডগুলোর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। এখন এই ডকইয়ার্ডগুলোতে শুধু মেরামতের কাজই সীমিতভাবে চলছে।
নেছারাবাদ উপজেলার ডকইয়ার্ড গুলোতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কয়েকটি ডকইয়ার্ডে কমপক্ষে ৫০ থেকে ১০০ জন শ্রমিকের জায়গায় কাজ করছে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন। বিশাল আকারের জাহাজ নির্মাণের জায়গাগুলো খালি পড়ে আছে। আগের মতো লোহার শব্দ নেই। নদীর পাড়ে পড়ে থাকা জাহাজের খোলা খোলস যেন কথা বলছে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের জীর্ণ দশার।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগ না থাকলে এই শিল্প পুরোপুরি বিলুপ্তির পথে যাবে। অথচ নেছারাবাদের ডকইয়ার্ড শিল্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলে একটি সম্ভাবনাময় খাত হতে পারত।
নুরুল হায়দার নামে এক শ্রমিক বলেন, আমি প্রায় ১৮ বছর ধরে এই কাজ করি। ডকইয়ার্ডে এখন তেমন কাজ নেই। যে মজুরি পাই তাতে আমাদের সংসারও চলে না। সরকার যদি আমাদের একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দিত যদি একটা সার্টিফিকেট এর ব্যবস্থা করত তাইলে আমরা অন্য জায়গায় গিয়েও কাজ করতে পারতাম।
মো. রিয়াজ নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আগে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা রোজগার হইতো, এখন হাত গুটাইয়া বসে আছি। যদি সরকার কিছু সহযোগিতা করত, এই শিল্প আবার দাঁড়াইত। নইলে আমাদের সবাইকে না খেয়ে মরতে হবে।
জাহাজ মালিক কামরুল ইসলাম বলেন, মূলত এই জাহাজ ব্যবসা আগের মতো আর নেই। করোনার পরে বিদেশী জাহাজ এখন আর বাংলাদেশে আসে না। এ কারণে আমরা জাহাজের কাঁচামাল এবং পুরাতন জাহাজের মাল পাচ্ছি না। এ কারণে কাঁচামালের দামও বেশি সব মিলিয়ে আমাদের জাহাজ ব্যবসা এখন আর আগের মতো নেই। এই ব্যবসায় সরকার যদি পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াতো তবেই ব্যবসাটি টিকে থাকতো।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সহজ শর্তে ঋণ, কাঁচামালের সহজলভ্যতা নিশ্চিতকরণ, প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং সরকারি তদারকি থাকলে এ শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, নেছারাবাদ উপজেলায় বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রয়েছে এর মধ্যে ডকইয়ার্ড শিল্প গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। নিজস্ব উদ্যোগে এখানের কিছু মানুষ এ উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে ডকইয়ার্ড শিল্প গড়ে তুলেছে।
ডকইয়ার্ড শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে নিয়ে গত বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলাম। যাতে করে তারা এই কাজটি ভালো করে করতে পারে এবং দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গড়তে ভূমিকা রাখতে পারে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন সার্বিক খেয়াল রাখছে।