জাতীয়
লাশের স্তূপ আর আর্তনাদ, এক চিকিৎসকের চোখে জুলাইয়ের রণাঙ্গন
জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। হাজারো ছাত্র-জনতার লাশ, অগণিত মানুষের চোখ, হাত-পা হারানোর মতো অবর্ণনীয় বেদনার বিনিময়ে গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিল এক নতুন সূর্য, এসেছিল এক কাঙ্ক্ষিত বিজয়। যে বিজয়ের পেছনে রয়েছে অগণিত তরুণের রক্ত আর স্বজন হারানো পরিবারের কান্না।
জুলাই-আগস্টের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে যখন রাজপথ ছিল উত্তাল, তখন হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগ হয়ে উঠেছিল আরেক যুদ্ধক্ষেত্র।
সেই রণাঙ্গনের একজন সম্মুখযোদ্ধা ও প্রত্যক্ষদর্শী কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুমাইয়া আক্তার। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ের ভয়াবহতা, ত্যাগ আর অকল্পনীয় মানবিক সংকটের এক জীবন্ত চিত্র।
গতকাল সোমবার (৪ আগস্ট) ঢাকা পোস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলাই-আগস্টের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনফার্টিলিটি বিভাগে কর্মরত এই মেডিকেল অফিসার। তার বর্ণনায় উঠে এসেছে একদিকে গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন তরুণদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা। অন্যদিকে, লাশের স্তূপ আর অসহায়ত্বের এক হৃদয়বিদারক চিত্র।
ডা. সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘শুরুটা হয়েছিল ১৫ জুলাই। কিন্তু ১৮ তারিখের পর থেকে পত্রপত্রিকা আর টিভির সংবাদে আমরা যে ভয়াবহতার আঁচ পাচ্ছিলাম তার সরাসরি ঢেউ এসে লাগতে শুরু করে আমাদের হাসপাতালে।’
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন ২৬ জুলাইয়ের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার। ডা. সুমাইয়া বলেন, ‘আপনারা যারা কুর্মিটোলা হাসপাতালে গিয়েছেন, তারা জানেন যে বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় জরুরি বিভাগগুলোর একটি সেখানে। কিন্তু সেদিন আমাদের জরুরি বিভাগে পা ফেলার কোনো জায়গা ছিল না। আমরা যে হেঁটে গিয়ে একটা রোগীকে দেখব, সেই শারীরিক স্থানটুকুও অবশিষ্ট ছিল না।’
অসহায়ত্ব ও কর্তব্যের লড়াই
২৬ জুলাইয়ের প্রায় প্রতিটি রোগীই ছিলেন বন্দুকের গুলিতে আহত। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, “সেখানে ছররা গুলি বা পেলেট ইনজুরি খুবই কম ছিল। প্রায় প্রতিটিই ছিল গানশট ইনজুরি। সেই আঘাতগুলো কোন মাত্রার ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা যে বুলেটগুলো রোগীদের শরীর থেকে বের করেছি, তার বেশির ভাগই ছিল লম্বাটে, আবার কিছু ছিল গোল আকৃতির। সেদিন অসংখ্য ‘ব্রট ডেড’ অর্থাৎ হাসপাতালে আনার আগেই মৃত রোগী আমরা পেয়েছি, যাদের প্রত্যেকের মৃত্যুর কারণ ছিল গানশট ইনজুরি।”
এই পরিস্থিতি কেবল একদিনই ছিল না, ২৭ জুলাইয়েও এর রেশ থেকে যায়। ডা. সুমাইয়ার মতে, সেদিন যাদের হাসপাতালে আনা হয়েছিল তাদের অধিকাংশই ছিলেন উত্তরা ও ইসিবি চত্বরের গণহত্যার শিকার।
একদিকে অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীর আর্তনাদ, অন্যদিকে সীমিত সামর্থ্য— এর মধ্যে চিকিৎসকদের লড়াইটা ছিল আরও কঠিন। ডা. সুমাইয়া বলেন, ‘সেদিন নিজের আবেগ-অনুভূতির কথা ভুলে গিয়ে অনেকটা চোখ বন্ধ করেই সেবা দিয়ে গেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছিল সবাইকে আমরা সেখানে চিকিৎসা দিতে পারছিলাম না।’