গৌরনদী
বরিশালে বোমা বিস্ফোরণে মৃত্যু: হাসানাত আব্দুল্লাহর ভয়ে ১৩ মাস পর হত্যা মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক : বরিশালে ২০২৪ সালে উপজেলা নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধের সময় বোমা বিস্ফোরণে কামাল বেপারী নামে একজন নিহত হওয়ার ১৩ মাস পর হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন স্বজনরা। ওই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর অনুসারী হওয়ায় ভয় থেকে মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাদী।
আদালতের নির্দেশে মামলাটি বরিশালের গৌরনদী মডেল থানায় এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তদন্তের কাজও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন গৌরনদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তরিকুল ইসলাম। তিনি জানান, মামলায় সাতজনকে নামধারী আসামি এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়।
নিহত কামাল বেপারী মুলাদী উপজেলার পূর্ব তয়কা গ্রামের মৃত সেলিম বেপারীর ছেলে। গৌরনদীর ধানডোবা গ্রামে বোমার আঘাতে নিহত হওয়ার আগে তিনি ঢাকার সেয়ারীঘাটে কসাইয়ের দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন। আর মামলার বাদী তার মামাতো ভাই ও মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার খুনের চর এলাকার মজিবর বালীর ছেলে মো. দুলাল বালী।
মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে তারা হলেন মুলাদী উপজেলার চিঠির চর গ্রামের মালেক শিকদারের ছেলে আব্বাস শিকদার, বরিশাল মেট্রোপলিটনের বিমানবন্দর থানার করমজা গ্রামের মৃত লতিফ হাওলাদারের ছেলে নুরুল ইসলাম, মুলাদীর সাহেবেরচর গ্রামের মৃত মালেক বেপারীর ছেলে আবু হানিফ, চিঠির চর গ্রামের মৃত জোনাবালী শিকদারের ছেলে শাহিন শিকদার ও আনু শিকদার, খুনেরচর গ্রামের মৃত রশিদ বালীর ছেলে ওহিদুল বালী, তয়কা গ্রামের আমিন আকনের ছেলে লেলিন আকন।
মামলার প্রধান আসামি আব্বাস শিকদারের বড় ভাই আলতাফ হোসেন ছিলেন বরিশাল-১ (গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর গানম্যান।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে উপজেলা নির্বাচনে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর প্রধান সহযোগী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র (বর্তমানে জেলহাজতে থাকা) হারিছুর রহমান হারিছের পক্ষে লোকজন জড়ো করা হয় গৌরনদীতে। ওইসময় মামলার আসামিরাসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫ জন লোক গৌরনদীর ধানডোবা গ্রামের শিমুল মেম্বারের বাড়িতে যায়। সেখানে কামাল বেপারীকেও কৌশলে ডেকে নেওয়া হয় এবং ২৩ জুন রাতে সবাই ধানডোবা গ্রামের ওয়াদুদ সরদারের পানের বরজে যায়। পরে সেখানে মামলার প্রধান আসামি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর গানম্যান আলতাফ হোসেনের ছোট ভাই আব্বাস শিকদারের নির্দেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটনো হয়।
যে বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি নিহত হন এবং কামাল বেপারী গুরুতর আহত হন। ওই সময় মামলার আসামিরা অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ গুম করে ফেলে এবং কামাল বেপারীকে হাতে ও পায়ে কুপিয়ে আরও গুরুতর জখম করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে মুমুর্ষ অবস্থায় কামাল বেপারীকে রেখে আসামিরা পালিয়ে যায়, তবে আহতের মুখ থেকে বাদী ঘটনা সম্পর্কে অবগত হন।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২৪ সালের ২ জুলাই কামাল বেপারী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করলে তার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। পরবর্তীতে লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়।
মামলার বাদী দুলাল বালী অভিযোগ করে বলেন, কামাল বেপারী ও সাক্ষীদের কাছ থেকে ঘটনা শুনে তৎকালীন সময়ে গৌরনদী মডেল থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে আমাদের ভয়ভীতি দেখায়। এছাড়া প্রধান আসামি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতার লোক হওয়ায় পরবর্তীতে মামলা দেওয়ারও সাহস পাচ্ছিলেন না। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা গৌরনদী মডেল থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে তাদের আদালতে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই তারা আদালতে মামলাটি দাখিল করেন।
সার্বিক বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গৌরনদী সার্কেল) শারমিন সুলতানা রাখি জানান, আদালতের নির্দেশে গত ২১ জুলাই মামলাটি থানায় এজাহারভুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে ঘটনাটি প্রায় ১৩ মাস পূর্বের হওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে ভালো কিছু বের হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই নিহত ব্যক্তি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি থানার শিতলতারা এলাকার কাঞ্চন মাঝির ছেলে জাহাঙ্গীর মাঝি।
সে সময়ে অভিযোগ উঠেছিল, ঘটনার পরপরই পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হারিছুর রহমানের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয়েছিল। যে কারণে ওইসময় চাঞ্চল্যকর এ বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।