কলাপাড়া
কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা
কলাপাড়ায় ২০ হাজার একর কৃষিজমি আবাসন আগ্রাসনে
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ পর্যটন এলাকা কলাপাড়া ও কুয়াকাটায় অন্তত ২০ হাজার একর কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে গেছে। এসব জমির অন্তত এক তৃতীয়াংশ এখন স্থায়ীভাবে পতিত হয়ে গেছে। এ কারণে এখানে প্রতি বছর অন্তত ৩২ হাজার মেট্রিক টন ধানসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশস্যের উৎপাদন কম হচ্ছে। অন্তত এক যুগ ধরে এই অবস্থা শুরু হয়েছে। ক্রমশ অনাবাদী জমির পরিমাণ বাড়ছে।
এছাড়া কয়েক কোটি টাকার রবিশস্যসহ শাকসবজির আবাদ বন্ধ হয়ে গেছে। কুয়াকাটায় প্রতি বছর শুধুমাত্র কয়েক কোটি টাকার তরমুজের আবাদ হতো। যা এখন হয় না বললেই চলে। আবাসন আগ্রাসনে সাগরপাড়ে কৃষিক্ষেত্রে মানুষসৃষ্ট এমন বিপর্যয় যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে।
এভাবে কুয়াকাটা পর্যটন এলাকা ছাড়া এর আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার অধিকাংশ কৃষিজমি কৃষকের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের খাজুরা থেকে পর্যটনপল্লী গঙ্গামতি এবং কাউয়ারচর পর্যন্ত দীর্ঘ এলাকায় এমনচিত্র বিদ্যমান রয়েছে। কৃষিকাজে ব্যবহারের অন্তত পাঁচ হাজার একর জমি পতিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ফলে খাদ্য উৎপাদনে দ্বিগুন উদ্ধৃত্ত কলাপাড়া এখন খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি পড়ার আশঙ্কা হয়েছে। কৃষকের মালিকানা অন্তত পাঁচ হাজার একর কৃষি জমির মালিক বনে গেছে এক শ্রেণীর আবাসন ব্যবসায়ীসহ জমি বেচাকেনার দালালরা। যদিওবা এখন পর্যন্ত অর্ধেক জমিতে হালচাষের কাজ চলছে। কিন্তু মালিকানা পাল্টে গেছে।
জমির মালিকানা বদল প্রক্রিয়া শুরু হয় প্রায় ২০ বছর আগে। কিন্তু এসব জমিতে এখন পর্যন্ত কোন ধরনের স্থাপনা তোলা হয় নি। তবে কুয়াকাটা পৌর এলাকাসহ তার আশেপাশের জমির চারদিকে দেয়াল কিংবা পিলার দেয়া হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ওইসব জমিতে হালচাষ। ধানসহ কৃষিউৎপাদন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি এসব এলাকার কৃষকসহ হাইলা-কামলা এবং কৃষি শ্রমিকরা হারিয়েছে তাদের কর্মক্ষেত্র। এসব এলাকার মানুষ ১১/১২ বছর আগে তাদের উৎপাদিত ধানসহ রবিশস্য নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফলন এলাকার বাইরে বিক্রি করত। অথচ বর্তমানে নিজেদের বছরের খোরাকি চাল পর্যন্ত এলাকার বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। সব ধরনের খাদ্য সামগ্রীর জন্য এলাকার বাইরের হাট-বাজার কিংবা মোকামের দ্বারস্থ হতে হয়।
কৃষিনির্ভর এই এলাকায় এখন কৃষি জমি হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে চাষাবাদ হচ্ছে এসব জমির মধ্যেও বিভিন্ন আবাসন কোম্পানির অসংখ্য সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে। কলাপাড়া উপজেলার ২০১১ সালের ল্যান্ডজোনিং রিপোর্ট অনুসারে উপজেলার লতাচাপলী এবং ধুলাসার ইউনিয়নে মোট জমির পরিমাণ ২৫ হাজার দুই ’শ ৭৩ একর। এর মধ্যে কৃষি জমির পরিমাণ ১৩ হাজার চার ’শ ৪১ একর। বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার অবস্থান লতাচাপলী ইউনিয়নে এবং পর্যটনপল্লী গঙ্গামতির অবস্থান ধুলাসার ইউনিয়নে।
অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায়, লতাচাপলী ইউনিয়নের পশ্চিম খাজুরা গ্রাম থেকে গত পাঁচ বছরে অন্তত ৫০টি কৃষক ও জেলে পরিবার এখান থেকে বাড়িঘরসহ চাষের জমি বিক্রি করে চলে গেছে অন্যত্র। শুধু পশ্চিম খাজুরা নয়। একই দৃশ্য মাঝিবাড়ি, মিরাবাড়ি, পশ্চিম কুয়াকাটা, কুয়াকাটা, কেরানিপাড়া, নবীনপুর, শরীফপুর, মম্বিপাড়া, হুইচেনপাড়া, বড়হরপাড়া, মম্বিপাড়া, গঙ্গামতি, ধুলাসার, নতুনপাড়া, কাউয়ারচর, বটতলাসহ সর্বত্র।
হাজার হাজার একর জমিতে এখন দাড়িয়ে আছে অসংখ্য সাইনবোর্ড। এক যুগ আগের দেখা মানুষের কাছে এই দীর্ঘ এলাকা এখন অপরিচিত মনে হয়। যেন স্থায়ীভাবে অনাবাদী হয়ে পড়ছে মাইলের পর মাইল কৃষি জমি। ফলে অন্তত ৫০ হাজার মানুষের খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেভাবে কৃষি জমি দ্রুত অনাবাদী হচ্ছে তাতে সাগর পারের কৃষি জনপদ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে না দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সেখানে কী পরিমাণ কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে পড়ছে। খাজুরা বাঁধের ছোট্ট দোকানি মো. ফরহাদ হোসেন। বয়স প্রায় ৬০ বছর। প্রায় দেড়যুগ ছোট্ট ব্যবসার পাশাপাশি গবাদিপশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন।
এখন চাষাবাদ করে সবজি রবিশস্য আবাদের জমি তার নেই। এখন গোটা এলাকার কৃষি জমি দেখলে মনে হয় যেন বিরাণ ভুমিতে পরিণত হয়েছে। অথচ ১৫-২০ বছর আগেও এই বিশাল এলাকাজুড়ে ধানের পাশাপাশি তরমুজ, ডাল জাতীয় ফসলের বাম্পার ফলন হতো।
জানা গেলে, ইয়েস বাংলা ছাড়াও ইউনিক কোম্পানি প্রায় ১০ একর, সাগর নীড় প্রকল্পের বিরাট এলাকা দেড়যুগ ধরে অনাবাদি পড়ে আছে। ওই এলাকা থেকে ইতোমধ্যে ওয়াজেদ খান, শামসুল হক, মুনসের, ফজু হাওলাদার, মোসলেম আলী, কালামসহ বহু কৃষক তাদের জমিজমা বিক্রি করে পাশের তালতলীসহ বিভিন্ন স্থানে চলে গেছে। যারা রয়েছেন তারাও ভরাটের কারণে চাষাবাদ করতে পারছেন না। সুলতান ও এমাদুল জানালেন তারা নিজেরাই কত বছর ধরে তরমুজের আবাদ করতে পারেন নি। নিরাপদ পানির সঙ্কট চলছে। দুরের কোন গভীর নলকুপ একমাত্র ভরসা। মোট কথা চাষাবাদ তো দুরের কথা এখন হাজার হাজার শ্রমজীবি ও কৃষক পরিবারের বসবাসে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
স্থানীয়রা জানান, হাজার হাজার একর কৃষি জমি হাউজিং কোম্পানি কিনে বাউন্ডারি করে ফেলে রেখেছে বছরের পর বছর। এভাবে খাজুরা থেকে চরকাউয়া এবং গঙ্গামতি পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় কৃষি জমিতে এখন শত শত সাইনবোর্ড দাড়িয়ে আছে। এসব এলাকার শ্রমজীবি হাইলা-কামলা শ্রেণীর হাজার হাজার পরিবারও রয়েছে আবাসস্থল হারিয়েছে। অধিকাংশ জমি পড়ে আছে পতিত অবস্থায়। ২০১১ সালের ১৩ নবেম্বর ভূমি মন্তণালয়ের সচিব মো. মোখলেসুর রহমান কলাপাড়ায় ল্যান্ডজোনিং বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় স্পষ্ট করে বলেছেন কুয়াকাটায় হাউজিং কোম্পানির ব্যবসায় কোন ধরনের অনুমতি সরকারিভাবে দেয়া হয়নি।
এছাড়া ভূমি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনে বলা আছে কৃষি জমি কোন কৃষক ছাড়া হস্তান্তর করার সুযোগ নেই। আর কৃষি জমিতে আবাসন ব্যবসার কোন সুযোগ তো নেই। তারপরও কোন ধরনের নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেই কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা পর্যটন এলাকাসহ সর্বত্র কৃষি জমি কিনে ভরাট করা হয়েছে। ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহতের আশঙ্কা রয়েছে।
সবুজের আস্তরণে ঢেকে থাকা সাগরপারের জনপদ পরিণত হতে যাচ্ছে যেন বিরানভূমিতে। এসব বিরুপ প্রতিক্রিয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েক বছর আগে খাজুরা এলাকার সহস্রাধিক কৃষক-কৃষাণী এবং সাধারণ মানুষ মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। কিন্তু কোন প্রতিকার হয় নি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ জানান, সরকারিভাবে কলাপাড়ায় অন্তত আট হাজার হেক্টর কৃষি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে হেক্টর প্রতি অন্তত ৪ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হতো। তবে এখন জমি কমলেও কৃষকরা উন্নত জাতের ধানের আবাদ করে ফলন বাড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে কৃষি জমি রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।