বরিশাল সদর
করোনার থাবায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে বরিশাল নগরী
মির্জা রিমন ॥ মরণঘাতী করোনাভাইরাসের থাবায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে বরিশাল নগরী। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পর করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে বরিশাল নগরীতে। প্রতিদিনই আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। গত ২ দিনে অর্থাৎ গত ৩০ ও ৩১ মে বরিশাল জেলায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৮৯ জন। তার মধ্যে ৬৮ জনই বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বাসিন্দা। এই নিয়ে বরিশাল মহানগরীতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৪৭ জন। আর গোটা জেলায় এর সংখ্যা ৩১৯ জন। বরিশাল মহানগরী করোনার হটস্পট হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে লকডাউনের শিথিলতা। অপরদিকে আমরা কোভিড-১৯ এর ৩য় স্টেজ এ প্রবেশ করে ফেলেছি। ৩য় স্টেজ’র অর্থ হলো কার, কিভাবে, কোথা থেকে এবং কার থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হচ্ছে তা আর খোঁজ পাওয়া সম্ভব না। মানে Community Spread হতে যাচ্ছে এবার। এই পর্যায়টি হল সবচেয়ে মারাত্মক পর্যায়, জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এই পর্যায় দেশ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা থেকে যায়। কারণ এই সময় থেকে শুরু হয় কমিউনিটি স্প্রেডিং। আর এটি এখন চলছে বরিশাল মহানগরীতে। মূলত বরিশাল মহানগরীতে কমিউনিটি স্প্রেডিং শুরু হয়েছিল ঈদের আগে নগরীর অলিগলি থেকে প্রাণকেন্দ্রের সকল দোকান-পাট খোলা রাখার জন্য। এসময় ক্রেতা-বিক্রেতাদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ যে নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছিল তা বিন্দুমাত্র পালন করা হয়নি। স্বাস্থ্যবিধির কিছুই মানেনি ক্রেতা-বিক্রেতারা। এমনকি শিশু এবং বয়স্কদেরও ঈদের কেনাকাটায় মার্কেটে নিয়ে আসছেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি উপেক্ষিত হওয়ায় করোনা সংক্রমণ ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে নগরীতে। এছাড়াও ঈদের সময় বাস ও লঞ্চের মতো গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও নানাভাবে বরিশাল এসেছেন ঢাকা, গাজীপুর বা নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য বাসিন্দা। ফলে আক্রান্ত শহরগুলো থেকে যারা বরিশাল এসেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো এই ভাইরাসটি দ্বারা আক্রান্ত ছিল। তবে তখন হয়তো কোনো উপসর্গ ছিল না, তারা নিজেরাও জানত না যে তারা আক্রান্ত। এভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাদের সংর্স্পশে এসেছে কিংবা নগরীর যেসব এলাকায় ঘোরাঘুরি করেছে সেই জায়গাগুলোয় সংক্রমণের একটা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। যার ফলাফল এখন বাস্তবে দেখছে নগরবাসী। এদিকে আক্রান্তের সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বরিশাল জেলায় গত ১২ এপ্রিল প্রথম দুজন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত দিনে ২ থেকে ৮ জন শনাক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২১ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত তা অনেকটা বেড়ে দিনে ১১ থেকে ১৮ জন হয়েছে। ৭ মে পর্যন্ত বরিশাল জেলায় কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা ছিল ৪৯ জন। এরপর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১ জনে। তৃতীয় সপ্তাহে সংখ্যাটি হয় ১২৪ জন। আর ২১ থেকে ২৮ মে অর্থাৎ শেষ সপ্তাহে এটি দাঁড়ায় ২০৮ জনে। এ থেকে স্পষ্ট প্রতিয়মান হয় যে, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে লকডাউনের শিথিলতায় বরিশাল নগরীতে শুরু হয়েছে কমিউনিটি স্প্রেডিং। শুধু যে নগরীর সাধারন জনগনই করোনা আক্রান্ত হচ্ছে তা নয়। লকডাউনের শিথিলতার কারনে অধিকতর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অসংখ্য সদস্য। সাধারণ মানুষের পাশে থেকে এসব মানবিক এবং প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে বরিশালের সম্মুখ যোদ্ধারা এখন ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসের শিকার। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অনেক সদস্যের অভিযোগ ঈদের জন্য হঠাৎকরে মার্কেট খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং তার মধ্যে পুলিশের দায়িত্ব পালনে জনগণের মাঝে মিশে যাওয়াতেই পুলিশে সংক্রমণ বেড়েছে। এখন পর্যন্ত বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ৬৮ জন সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। পাশাপাশি নগরীতে স্বাস্থ্য বিভাগের ১৫ জন চিকিৎসকসহ মোট ৪৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে শুরু করে। ঈদকে সামনে রেখে লকডাউন শিথিল করা এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের উদাসীনতা এর জন্য দায়ী। তিনি বলেন, ঈদ বাজার নিয়ন্ত্রণে শিথিলতার কারণে সামাজিক দূরত্বের কোনো বালাই ছিল না। ফলে দ্রুত গতিতে করোনার সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে নগরবাসীর মাঝে। এদিকে সচেতন মহল বলছে, সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা বরিশাল বিভাগের মধ্যে বিভাগীয় শহর বরিশালে আক্রান্তের সংখ্যা অসংখ্য হারে বাড়ছে। আর তাই করোনার নতুন হটস্পট হিসেবে বরিশাল মহানগরীকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তাদের দাবি আক্রান্তদের অসচেতনতার কারণেই করোনার নতুন হটস্পটে পরিনত হয়েছে বরিশাল মহানগরী। বিশেষ করে ঈদের পূর্বে মার্কেটগুলো উন্মুক্ত করে দেয়া এবং সেই সুযোগে অসচেতন মানুষগুলোর পরিবার নিয়ে মার্কেটে ঘুরে বেড়ানোর কারণেই নগরীতে আক্রান্ত শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নগরীতে করোনা শনাক্তের কার্যক্রম আরো জোড়ালো এবং বেশি বেশি পরীক্ষার জোর দাবি তাদের। তবুও আশার বিষয় হল দেশে করোনা আক্রান্তে মৃতের থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষের সংখ্যা অনেক বেশী। দেশের চিকিৎসক, সরকার, প্রশাসন এবং অন্যান্য ইমার্জেন্সি সার্ভিস যেভাবে তৎপরতার সাথে কাজ করে চলেছে সেখানে দেশবাসীর সাহায্য পেলে বাংলাদেশ এই করোনা ভাইরাসের মোকাবিলা করতে এবং জয়ী হতে সক্ষম হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, বরিশাল মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা সমূহে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা হলো বরিশাল মহানগরীতে ২৪৭ জন, সদর উপজেলা ৮ জন (রায়পাশা কড়াপুর, শায়েস্তাবাদ, টুংঙ্গীবাড়িয়া, জাগুয়া, চরকাউয়া এবং চরমোনাই), বাবুগঞ্জ ১৩ জন, উজিরপুর ১১ জন, মেহেন্দীগঞ্জ ৬ জন, বাকেরগঞ্জে ১২ জন, হিজলা ৫ জন, মুলাদী ৫ জন, বানারীপাড়া ৬ জন, আগৈলঝাড়া ৩ জন এবং গৌরনদীতে ৩ জন।