ভোলা
ভোলায় ২০০ বছরের পুরোনো পুকুর দখল, উঠছে বহুতল ভবন
ভোলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ২০০ বছরের পুরোনো সরকারি শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের (বাংলাস্কুল পুকুর) দখলের অভিযোগ উঠছে। মাটি ভরাট করে অব্যাহত দখলে দিনদিন ছোট হয়ে আসছে ওই পুকুর, গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। পুকুরটিকে অক্ষত ও দখলমুক্ত করতে সচেতন মহল দাবি জানিয়ে আসলেও প্রশাসন নিরব।
ঐতিহ্যবাহী বাংলাস্কুল পুকুরে মানুষ গোসল করতেন। নানান কাজে ব্যবহার করতেন পানি। শহরে আগুন লাগলে এই পুকুরের পানিই ছিল ভরসা। কিন্তু দখলদারদের কবলে পড়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুরটি। পার্শ্ববর্তী ভবন মালিকরা পুকুরপাড়ের জমি লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন বহুতল পাকা ভবন।
বিজ্ঞাপন
এমন পরিস্থিতিতে পুকুরটি দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধারে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন মানববন্ধন, জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উদ্ধারে ব্যার্থ হয়েছেন প্রশাসন।
জানা গেছে, এক সময়ে পুকুরটি আয়াতন ৯৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে সেটি আছে ৭০ শতাংশ। কাগজে-কলমে ভরাট হয়েছে ২৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। তবে বাস্তবে এটি আরও অনেক বেশি ভরাট হয়েছে। দলীয় প্রভাবশালীরা ক্ষমতার দাপটে ও কয়েকটি সংগঠনের থাবায় বিশাল পুকুরটি এখন ছোট হয়ে গেছে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্রে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুকুরের জমিতে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়, চেম্বার অব কমার্সের কার্যালয় ও বাংলাদেশ রাইফেলস ক্লাব, স্কাউটস ভবন নির্মাণ করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতি ও সেলিম শপিং সেন্টার নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পুকুর পাড়ের জমি ইজারা নিয়ে পুকুরটি ভরাট করছে। এছাড়াও পুকুরের জমি দখল করে অবৈধভাবে ভোলা পৌর বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবন ও বাংলাস্কুলের কর্মচারীদের থাকার জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে পুকুরের এক তৃতীয়াংশ দখল হয়ে গেছে।
ভোলা পৌরভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভোলা শহরের চর জংলা মৌজার ১৬৪ নম্বর খতিয়ানের ১১৪১ দাগে ৯৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ জমিতে পুকুর। ১১৩২ ও ১১৪০ দাগে পুকুর পাড়ের জমি রয়েছে ৯ দশমিক ৪০ শতাংশ। পুকুর আর জমি মিলে এক একর ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। বর্তমানে কাগজপত্রে পুকুর রয়েছে ৭০ শতাংশ। সর্বশেষ পুকুরটি ভোলা টাউন কমিটি (বাংলাস্কুল) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। পাড়ের জমির সরকারি ইজারা হিসেবে পশ্চিম পাড়ে রয়েছে শ্যামল দত্ত গং, সেলিম, নয়ন সেন। দক্ষিণ পাড়ে চেম্বার অব কমার্স, স্কাউটস অফিস, আওয়ামী লীগ অফিস, রাইফেলস ক্লাব, আবু তাহের। পূর্ব পাড়ে কোনো প্রকার ইজারা না নিয়ে ভোলা পৌর বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন ও বাংলাস্কুলের কর্মচারীদের থাকার জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে।
২০২২ সালে পুকুরটি দখলমুক্ত করতে তৎকালিন জেলা প্রশাসক বরাবর স্থানীয় সচেতন মহল স্মারকলিপি প্রদান করেন। স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ভোলা পৌরসভার (শহরের মধ্যখানে) চরজংলা মৌজার শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়ের পুকুর (বাংলাস্কুল পুকুর) ও জমি বর্তমানে ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত। এ মৌজার পুকুরটি দুই শতাধিক বছরের পুরোনো। স্থানীয় প্রশাসন পুকুরটি বিভিন্ন সময়ে অস্থায়ী ইজারা (লিজ) দিয়েছে। ইজারাদাতারা আইন অমান্য করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। একই সঙ্গে অবৈধভাবে পুকুর ভরাট করে দখল করছেন। পুকুরের আশপাশে দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, একটি ডিগ্রি কলেজ, একটি আয়ুর্বেদিক কলেজ ও একটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় রয়েছে।
পুকুরটিতে আগে দুইটি পাকা ঘাটলা ছিল। একটি ঘাট দখল করে ভবন উঠেছে। এ পুকুরে এখনো বাজারের লোকজন গোসল করে, শিশুরা সাঁতার শেখে ও সাঁতার কাটে। শহরে অগ্নিকান্ড ঘটলে নিয়ন্ত্রণে পুকুরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ অবস্থায় পুকুরটির সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্ত করা ও খনন জরুরি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ভোলা জেলা শাখার সভাপতি মো. মোবাশ্বির উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ভোলা শহরের ঐতিহ্যবাহী এ পুকুর দখলমুক্ত ও সংরক্ষণের জন্য আমরা গত ১৫-২০ বছর ধরে আন্দেলন করে যাচ্ছি। পুকুরটি এক সময় অনেক বড় ছিলো। চারপাশ থেকে জেলা আওয়ামী লীগ অফিসসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ে ভরাট করে দখল করেছে। ভরাট করার সময় প্রশাসনকে জানানো হলে প্রশাসন ভরাট করা সাময়িক বন্ধ করলেও রাতের আঁধারে ভরাট করা হয়। এইভাবে আস্তে আস্তে ভরাট করা হচ্ছে। পুকুরটি দখল উচ্ছেদ করে সংরক্ষণ করা জরুরী। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে নিরব ভূমিকা পালন করছে।
জেলা আবৃত্তি সংসদের সম্পাদক মশিউর রহমান বলেন, ভোলা শহরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এ পুকুর অগ্নিনির্বাপণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহরের লোকজন এখানে গোসল করে। পুকুরটি ভোলা শহরের মানুষের জন্য অনেক উপকারী। গত ৫ আগস্টের পর এ পুকুর উদ্ধারে বর্তমান জেলা প্রশাসকের কাছে বিভিন্ন সংগঠন ১০ বার গিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রশাসনের লোকজনই ভূমি দস্যূদের সহায়ক শক্তি। আমরা চাই পুকুরটি দখল মুক্ত ও খনন করে সংরক্ষণ করা হোক।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান জানান, সরকারি পুকুর দখল করার কারো এখতিয়ার নেই। পুকুরটি দখলমুক্ত করতে এসিল্যান্ড ও ইউএনওকে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা নেওয়া জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুকুরটি দখলমুক্ত করতে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।